প্রিয়মুখ

অলোকা ভৌমিক একজন সংগ্রামী নারী

ছবি: নাইমুর রহমান

কৈশর থেকেই কাব্য চর্চার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ছিল অলোকা ভৌমিকের। সব হারিয়ে এখনও বই লিখে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ৭২ বছর বয়সী এই নারী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই লিখেছেন ১৩টি বই। তাঁর সাথে কথা বলেছেন,

-মিলন মাহমুদ রবি

গল্পটা প্রথমে গল্পই মনে হয়েছিল। তারপরও জানতে হবে কে সেই মহিয়সী নারী। কথা হলো নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার তিরাইল গ্রামে ভিটে হারানো পরবাসী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন অলোকা ভৌমিক। তাঁর কথাগুলো এখনও কানে বাজছে। যেমনটি জানলাম, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে রচনা করে চলেছেন- কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ (সনাতন ধর্ম বিষয়ক) কাব্যানুরাগীসহ লিখেছেন ১৩ টি বই। স্থানীয় কবি ও ছড়াকাররা তাকে চারণ বলে ডাকে। নিঃসন্তান অলোকা ভৌমিকের এখন আর দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই। নেই মাথা গোজার ঠাঁই। স্বামী মারা যাবার আগেই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিক্রি করা ভিটেতেই অলোকা ভৌমিককে আশ্রয় দেন ক্রেতা হামেদা বেগম। অসুস্থ প্যারালাইজড হয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন অলোকা ভৌমিক। হামেদা বেগম তাকে আর কোথায়ও ফেলতে পারলেন না। নিজের কাছেই আশ্রয় দিলেন।

ছবি: নাইমুর রহমান

অলোকা ভৌমিকের ব্যক্তি জীবন

১৯৪৭ সালের ১০ জানুয়ারি নাটোর জেলার শ্রীরামপুর গ্রামে বাবা জোতিষ চন্দ্র সরকার ও মাতা চমৎকারিনী সরকারের সংসারে জন্ম নেন অলোকা। তৎকালীন সময়ে মেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায় বেশি দূর এগোনো  সম্বভ হয়নি তাঁর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পাড় হতে পারেননি তিনি। কৈশর পেরোনোর আগেই ১৬ বছর বয়সে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার তিরাইল গ্রামে স্বামী বিশ্বনাথের বাড়িতে বধূ হয়ে আসেন অলোকা ভৌমিক। বিয়ের পর লেখাপড়া করার আগ্রহ জানালে বাধা আসে শ্বশুরালয় থেকে। এছাড়া স্বামীর কড়া শাসনতো আছেই। অলোকার সংসার জীবনে একটি মাত্র সন্তান হয়েছিল তাও মৃত। বেকার স্বামীর সংসারে একমুঠো ভাতের কষ্টে কতদিন যে চোখের পানিতে ভিজেছে বালিশ, সে কথা মনে পড়লে অশ্রু গড়ায় এখনও। মাতৃত্বের যন্ত্রণা আর স্বামীর বেপরোয়া শাসন যখনই দাগ কেটেছে তখনই কাগজ-কলম হাতে নিয়ে আলোর পথ খুঁজেছেন। শিশু শিক্ষা নিয়েই শুরু হয় পথ চলা। নিভৃতে জীবন যাপনকালে গহীন বুকে করেছেন কবিতার চাষ। লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে অলোকা ভৌমিক তার জীবনের অনুভূতিগুলো শব্দমালায় রুপান্তর করে চলেছেন ৫৭ বছর ধরে। প্রতিটি কষ্টের রাত আর মা ডাকের অনূভুতি না পাওয়ায় মূহুর্তগুলো গেঁথেছেন কবিতার ছন্দে। ৭৩ বছর বয়সী নিঃসন্তান অলোকা সব কিছু হারিয়েও দিশেহারা হননি। নিজ স্বামীর ভিটায় পরবাসী হয়েও অজো পাড়া-গাঁয়ে আধপেটা খেয়ে কাগজ-কলম কিনে লিখছেন কবিতা ও প্রবন্ধ। বয়স্ক ভাতা ও একমাত্র ভাইপোর পাঠানো অর্থ থেকে প্রতি মাসে সঞ্চিত কিছু অর্থে প্রতি বছর পাবনার রুপম প্রকাশনীর মাধ্যমে বের করেন একটি করে বই। লেখার নেশা তাকে এখনও মাতিয়ে রেখেছে।

 

অলোকা ভৌমিকের প্রকাশিত বই

লেখক অলোকা ভৌমিকের সব মিলিয়ে ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, কাব্যানুরাগী পাঠক মহলসহ সর্বস্তরে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। পেটের ক্ষুধা জিইয়ে রেখে মনের ক্ষুধা মিটিয়ে লিখে চলেছেন বই। তার বইগুলো হল- অমৃত, অমিয় বাণী, অমিয় সুধা (সনাতন ধর্ম বিষয়ক), একগুচ্ছ কবিতা (কাব্যগ্রহ্ন), সেতুবন্ধন (কাব্যগ্রহ্ন), নারীর আত্নকথা, উদয়ের পথে ( প্রবন্ধ), এক মুঠো রোদ্দুর (কাব্যগ্রহ্ন), অতৃপ্ত সনাতনসহ বেশ কিছু বই। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জীবনী নিয়ে লেখা বই সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমার কাছে আশ্চর্য মনে হতো। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)  সম্পর্কে যত যেনেছি তত মুগ্ধ হয়েছি। তাকে নিয়ে লেখা বই আধাঁরে আলো, এক মুঠো রোদ্দুর পড়লেই বোঝা যাবে। এছাড়া রাধা কৃষ্ঞ, নাটোরের রানী ভবানী, রানী রাসমনীর জীবন কাহিনী নিয়েও লিখেছেন। লেখক অলোকা ভৌমিক সম্পর্কে পাবনার স্থানীয় কবিরা বলেন চারণ কবি হিসেবে অলোকা ভৌমিক অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রতিটি লেখাই জীবন। তাঁর রচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, কাব্যানুরাগী পাঠক মহলসহ সর্বস্তরে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তাঁর ভাষার বুনন বিস্ময়কর। তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় আলোক’ছটা। অলোকা বলেন, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন লিখেই যাবো। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর একটিই চাওয়া রাষ্ট্রীয় ভাবে পুরস্কৃত হওয়া।

মানবিক কারণেই আশ্রয় দেই

আশ্রয়হীন হয়ে পড়া অলোকা ভৌমিককে আশ্রয় ও দেখাশুনার ভার নেন হামেদা বেগম। বললেন, যে কটা দিন বেঁচে আছে ওকে আমি কোথায়ও যেতে দেবো না। আমিও দু’মুঠো খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই। আমার স্বামী একজন দিনমজুর তাঁর সামান্য রোজগারে দিন চালাতে কষ্ট হয়। তারপরও আমি যতটুকু পারি তাকেও দেখে যাবো। তাঁর লেখালেখির জন্য যা প্রয়োজন হয় আমি সহায়তার চেষ্টা করি। তাঁর প্রকাশিত বই আমি বাড়ি বাড়ি যেয়ে বিলি করে আসি। কোন বইয়ের জন্য টাকা নেন না অলোকা দিদি। হামেদা বলেন, এখন আমার উপর ভার করেই তাঁর চলতে হয়। প্রতিবেশিরাও তাঁর খোঁজ খবর রাখেন। তাদের একত্রে বসবাস অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ। হামেদা বলেন, ধর্মে কি আসে যায়, দিন শেষে মানুষতো। এটাই আমার কাছে বড় সৌভাগ্যের। বড় পাওয়া।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031