সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-শাহিদা ইসলাম
আমার বাবা একজন সৎ এবং মহৎ একজন মানুষ ছিলেন। বেতনের টাকায় সংসার চলে ১৫ দিন, বাকি ১৫ দিন জীবন যুদ্ধ। মায়ের বাবার বাড়ি থেকে তাঁর ভাগের ফসলের টাকা পায়, তাই দিয়ে কোন মতে কেটে যায়, মা বাবাকে খুব সন্মান করেন। উনার জন্য আলাদা করে খাবার রেখে দিতেন। যখন বাজার থাকে না, একটা ডিম হলেও বাবার জন্য ভুনা করে রাখতেন, আমরা ভাই বোন চারজন। পড়াশুনা করতে যা লাগে তার কোন সংস্থান নাই। আমার কলেজ শেষ, টিউশনি করব ভেবে নিলাম। বাবাকে বলতেই ধমক দিলেন, পড়াশোনার ক্ষতি হবে, বড় হতে হবে, যাতে বাবার চাকরি আমি পাই।
মাকে বলেই পড়ানো শুরু করলাম। বিকাল ৪ টার থেকে ৬ টা, আমি রাস্তা দিয়ে যাবার সময় একদল বখাটে, পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে।
আজেবাজে কথা বলে, আমাকে পানি ছিটায়। এলাকার বড় ভাইদের কাছে বিচার দিলাম।
বড় ভাইরা উলটা আমাকে বলে তুমি এতো সুন্দর ওদের কি দোষ। আমরা বড়রাই তোমার রূপে দিওয়ানা। বাসায় এসে মাকে জানালাম।
পরের দিন আবার একই অবস্থা, বিপদ আমার পায়ে পায়ে, এদিকে বাবার চাকরির মেয়াদ শেষ।
দুই মাস পর ফেয়ার ওয়েল।বাবার মন্টাও খারাপ, অফিসে সবাই বলে আপনার চেয়ারে যেই আসুক, আপনার মত এত নিবেদিত প্রাণ হবে না।
মাঝে মাঝে মা এই কথাটা বলেন তুমি অফিসের জন্য যা করো এমন কেউ করে না, নিজের শরীরের দিকে একটু লক্ষ্য করো।
ইন্টারের রেজাল্ট বের হলো, ফাষ্ট ডিভিশন পেলাম,বাবার খুশি দেখে আমি ভ্যা করে কেঁদে দিলাম,বাবা অফিস থেকে কোন সময় টাকা এডভান্স নেন না, আজ নিয়ে এসেছেন, মেয়ের উপর কনভিডেন্স ছিল।
বাজারে গিয়ে মিষ্টি আনল, পাড়ার প্রতি বাড়িতে একটা, কালো জাম আর সাদা রসগোল্লা, আমি পিরিচের উপর সরপোষ দিয়ে ঢেকে একটা স্টিলের ট্রেতে করে নিলাম,
প্রথমে খুশিদের বাড়ি, দরজায় নক করতেই কে বলে চিৎকার করল, কেপে উঠলাম,
দরজা খুলল না, কারণ সেই মুহুর্তে না বুঝলেও পরের দিন বুঝলাম, খুশির রেজাল্ট ভাল হয় নাই।
বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে ঢাকা আসা, মালিবাগে কোচিং করি, ভার্সিটিতে ভর্তি হবার জন্য। থাকি রাজার বাগ হাসপাতাল গলি।
একটা আপুর সাথে রুমশেয়ার, দুজনা মিলেমিশে আছি। রান্না করতে পারি না তেমন, তবে যা পারি চলে, গলির মুখে মাস্তান গোছের কিছু ছেলের দল আমাকে দেখে গান ধরে, সুন্দরী চলেছে একা পথে, সংগী হলে দোষ কি তাতে?
আমার মন মেজাজ কিচ্ছু ভাল লাগে না, বাবাকে সব ঘটনা লিখে জানালাম। বাবা উওরে লিখলেন চোরের ভয়ে কি মানুষ কিছু কেনাকাটা করে না। তোমার চিন্তার কোন কারণ নাই। মাথা উঁচু করে বীর দর্পে ওদের পাছ করবা।
পরের দিন আবার একই গান, আমি তোয়াক্কা করলাম না, একজন বলল তোর রুপের দেমাগ আমি ভেংগে দেব, সব চুরমার করে দেব।
আমি থু বলে চলে এলাম কোচিং সেন্টারে, আসার সময় প্রচন্ড মেঘ এবং বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, তিনটায়৷ মনে হচ্ছিল রাত নয়টা।
সন্ধ্যা ছয়টা রাস্তা-ঘাট পানিতে ভেসে গেছে, মালিবাগ মোড় থেকে কোন রিক্সা পাই না, একটা বাস মোড় পর্যন্ত এলো, গলিতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সব দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ এই দূযোগের মধ্যে কেউ কেনাকাটা করতে বের হবে না,
আমি বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ রহম করো, এই বলতে বলতে আগাচ্ছি, হঠাৎ আমার উপর গরম আগুনের মত কি যেন ছুড়ে ফেলল, আমার মুখ ঝলসে গেল, সবাই বলছে এসিড এসিড, মাগো বাবাগো জ্বলে গেল পুড়ে গেল।
লোকজন ধরাধরি করে খিদমাহ হাসপাতালে নিয়ে গেল।ওখানে প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট দিয়ে, ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে দিল।
আমার ফোনে নাম্বার চেক করে বাবাকে জানিয়েছে, মা বাবা পাগলের মত ছুটে এসেছে, আমার চেহারার কোন আকার আকৃতি নাই।
নাকের থেকে চামড়া চোখের কোনা পর্যন্ত টান লেগেছে, ভ্রু জোড়া মিশে গেছে চামড়ার নিচে। গায়ের চামড়া সাদা, মুখের রঙ তামাটে,
আমার বাবার স্বপ্ন আমার আত্মবিশ্বাস ধুলায় মিশে গেল। এক বছর চলে গেল আমার জীবন থেকে, আমার রেগুলার পড়াশোনা মাটিতে মিশে গেল।হাসপাতালের বেডে শুয়ে মনকে শান্তনা দিলাম, ভার্সিটির করিডোরে যেতে পারলাম না এই কথাটা ঠিক না। আমার রূপ নাই, গুনের দিকে পিছিয়ে নেই। আজ আমি প্রতিষ্ঠিত ল ইয়ার, সমাজে আমার একটা পরিচিতি আছে, সন্মান আছে, মানুষ ভালবাসে কেউ কেউ করুণা করে, এসিড দুগ্ধ, নারী হিসাবে।
আমাদের জীবন যারা নষ্ট করেছে, তারা কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Add Comment