হ্যালোডেস্ক
জেনে নিই চীনে সেই আফিম যুদ্ধের কথা এবং এর আলোকে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার একটু বিচার বিশ্লেষণ।
আফিম যুদ্ধ হল ১৮৪০ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত চীনের ওপর বৃটেনের পরিচালিত এক আগ্রাসী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর থেকে চীন সামরাজ্যবাদীদের উপনিবেশে পরিনত হয়।
সামরাজ্যবাদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারলেও চীনে তারা অত সহজে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারেনি। কারন চীনারা অনেক আগে থেকেই জ্ঞান চর্চায় এগিয়ে ছিলো, তারা তাদের অঞ্চলগুলোকে সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ন করে তুলেছিলো যার ফলে পশ্চিমারা ওখানে সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না। তখন তারা দেখতে পেল যে চীনে আফিমের ভাল চাহিদা আছে, যা তারা স্বল্প মাত্রায় বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত। আফিমের মাত্রা বাড়িয়ে একে মাদক হিসেবে ব্যবহার তখনো চীনে ওভাবে শুরু হয়নি।
ব্রিটিশরা এই সুযোগ গ্রহণ করল। তারা ভারতে প্রচুর পরিমানে আফিমের চাষ করিয়ে তা ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এই আফিম ব্যপক হারে চীনে পাঠাতে শুরু করে এবং তা মাদক হিসেবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়। প্রথম দিকে এই মাদক অভিজাত শ্রেনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে তা সকল শ্রেনীর জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পরে। এর ফলে এটার চাহিদা এত বেশি বৃদ্ধি পেল যে চাহিদা মেটাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চীনে ব্যাপক ভাবে আফিমের চোরাচালান শুরু হয়।
এদিকে আফিম সেবন এতই প্রকট রুপ ধারণ করল যে চীনের অভিজাত পরিবার, সেনাবাহিনী সহ সাধারণ জনগন এর নেষায় আশক্ত হয়ে পরল।
আফিম চোরাচালান ও এর নেশার ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে পেরে ১৮০০ সালের দিকেই চীনা সম্রাট চিয়া চিং আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু ততদিনে চীনে এত বেশি মানুষ আফিমে আসক্ত হয়ে যায় যে এটা আর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিলো। এর ভেতরে বেশ কিছু অসাধূ ব্যবসায়ী আর কিছু দূর্নীতিবাজ রাজকর্মচারী বিষয়টাতে জড়িয়ে যাওয়ায় ঘুষের মাধ্যমে আফিমের চোরাচালান চলতে থাকে। ফলে সরকারে আইন শুধু আইনই থেকে গেল। বাস্তবে কোন ফল হলো না বরং দিনে দিনে চোরাচালন বাড়তেই থাকলো। ১৮০০ খৃষ্টাব্দে চীনে যে আফিমের আমদানির পরিমান ছিলো দুই হাজার পেটি মাত্র, তা ১৮৩৮ সালে এসে এর পরিমান দাঁড়ায় ৪০ হাজার পেটিতে। এক পেটিতে ১৪০ থেকে ১৬০ পাউন্ড পর্যন্ত আফিম থাকতো।
এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হলো যে চীনের কোয়াংটুং এবং ফুকিয়েন প্রদেশে ১০ জনের ৯ জন লোকই আফিমের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই আফিমের নেশা চীনের যুবসমাজ ও অর্থনীতি ধ্বংসের চুরান্ত পথে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে মাঞ্চু সরকার আফিমের চোরাই চালান বন্ধ করার জন্য চুড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখল না। সুতরাং মাঞ্চু সম্রাট ক্যান্টন বন্দরে একজন যোগ্য ও দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা লিন-সে-সু কে নিয়োগ দেন। তিনি নিয়োগ পেয়ে সেখানে কিছু কড়াকড়ি আইন প্রনয়ণ করেন।
অসাধু ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ রাজকর্মচারীদের দ্বারা এই আইন বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়াতে ১৮৩৯ সালে ১০ ই মার্চ ৫৪ বছর বয়সী লিন-সে-সু ক্যান্টন শহরের যে অঞ্চলে বিদেশী বাণিজ্য সংস্থাগুলো গড়ে উঠেছিল সেই অঞ্চল তিনি অবরোধ করেন। বণিকদের নিকট রক্ষিত সকল বেআইনী আফিম ছিল তা তিনি তাঁর হেফাজতে সমর্পন করার নির্দেশ দেন। বিদেশী বণিকেরা চাপে পড়ে ২০,০০০ পেটি আফিম লীনের কাছে জমা দিতে বাধ্য হয়। ১৮৩৯ সালে ২ জুন লিন-সে-সু জন সমক্ষে লবন ও চুন দিয়ে বিশাল পরিমান আফিম ধ্বংস করে দেন। যার বিনিময় মূল্য ছিল প্রায় ৬ মিলিয়ন টেইল। এই ঘটনাকে পুঁজি করে ব্রিটিশরা ওখানে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় যা চীনাদের কাছে ‘আফিমের যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত।
এই যুদ্ধে চীনকে শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়। কারণ তখন চীনের সেনা সদস্যদের মাঝে আফিমের নেশা ছিল প্রকট, যার ফলে তারা ঠিকমত যুদ্ধও করতে পারত না। দেখাযায় যে এই যুদ্ধে চীনাদের নিহত সৈন্যের সংখ্যা ছিল বিশ হাজার (২০,০০০) যেখানে ব্রিটিশদের নিহত সৈন্যের সংখ্যা মাত্র পাঁচশত (৫০০)।
এই যুদ্ধে চীন শুধু পরাজয়ই বরণ করেনি এর সাথে মেনে নিতে হয়েছে ব্রিটিশদের গোলামি। চীনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন বন্দর দিয়ে দিতে হয়েছে ব্রিটিশদের। দিতে হয়েছে সম্পূর্ণ চীনে অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার সাথে হারাতে হয়েছে ব্রিটিশদের শাষনের অধিকারও। অর্থাৎ নিজ দেশেই হতে হয়েছে পরবাস।
এখন বাংলাদেশ ও এগোচ্ছে এই আফিম যুদ্ধের দিকেই!
এদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা যেন আফিমের নেশার চেয়েও ভয়ংকর। সংসারে অশান্তি থেকে শুরু করে খুন, হত্যা, ধর্ষণ কোনটি না ঘটেছে এই ভারতীয় চ্যানেল নিয়ে?
একদিকে আফিমের নেশার মত নেশাগ্রস্থ হয়ে আছে পুরো জাতী অপর দিকে এই চ্যানেলগুলো বন্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সচেতন সমাজ। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেনা, কারণ এই নেশাগ্রস্থরা যে তাদেরই স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন। আর অসাধূ, দূর্নীতিবাজরা তো আছেই।
আফিমের নেশাতো চিকিৎসার মাধ্যমে ভাল হয় যার ফলে চীনারা এক সময় এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে, কিন্তু এই ভারতীয় চিভি চ্যানেলের নেশার কি কোন ঔষদ আছে? বাঙ্গালী কি কোন দিন এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে? নাকি আস্তে আস্তে পুরো জাতীকেই বিলিয়ে দিতে হবে ভারতীয় স্বার্থে? এখন শুধু প্রহর গোনার পালা।
আমাদের সাথে সংযুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন।
Add Comment