সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-সানি সরকার
সেই সকালে বাইক নিয়ে বেরিয়েছে নেহাল। আজ রবিবার। ডানা ঝাপটে যে-দিক ইচ্ছে ঘুরবার পক্ষে আদর্শ একটা দিন। সপ্তাহের আর দিনগুলো নেহাল নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা দেখা-শোনা করে। কর্মমুখর সেসব দিন। আজ নিজেকে অন্যরকমভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে। বন্ধুরা এখন নিজেদের নিজেদের জগত নিয়ে ব্যস্ত। কাছের এক বন্ধু মহুল, থাকে কৃষ্ণনগরে। একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে কাজ করে। মাঝে মাঝে কখনও কথা হয়, স্কুল কলেজের সেইসব দিনের মত নিভৃত টান যেন ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সৌরভ নামে এক বন্ধু ছিল। দক্ষিণ দিনাজপুরে বাড়ি। কলেজস্ট্রিটে একটি মেস বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করত। অসম্ভব সুন্দর কবিতা লেখার হাত। নেহালের সাহিত্যের প্রতি খুব একটা টান না থাকলেও, খারাপ লাগত না কখনও-ই। সৌরভের কবিতার খাতাটা চেয়ে নিয়ে পড়েছে। কি অপূর্ব পঙক্তি, বিন্যাস। মনে আছে :
‘মেঘ পালকের মত উড়তে উড়তে / মেয়েটি হারিয়ে গেল সবটুকু লাবণ্য নিয়ে/ বিকেলের নির্মোহ জনস্রোত থেকে একটি কিশোর বালক/ খুলে খুলে ফেলল তার জমানো রোদ্দুর/ ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে-‘।
সেই সৌরভ কলেজ জীবন শেষ করে কোথায় চলে গেল! আর নেহাল সেও কি ব্যতিক্রম নাকি! তাকেও কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দায়িত্ব নিতে হয়েছে ব্যবসার। সাথ দিতে হয়েছে বাবাকে, দাদাকে। তবু ব্যবসাটিকে আজও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। প্রথম যেদিন নেহালের বাবা নেহালকে বললেন, তুমি এখন স্নাতক। আর তুমি এতদিনে নিশ্চয় বুঝেছ, আমাদের পরিবারের নিয়মই হচ্ছে, স্নাতক হলেই তার নিজের জীবনটিকে নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। আমরাও তা-ই করেছি। নেহাল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। দাদা-বৌদি, মা দাঁড়িয়েছিলেন একটু দূরে, নেহাল এতক্ষণে বলল,
-কিন্তু বাবা-
-কিন্তু কী?
-আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে স্পেশালাইজেশন করব।
-হ্যাঁ। তুমি করতে পারো। আমি বারণ করব না। কিন্তু সেটা তোমাকে নিজের চেষ্টায়, নিজের উপার্জনে করতে হবে।
নেহাল জানে, এটি-ই বাবার শেষ কথা। এ কথার কোনও নড়চড় হবে না। বাবার কথার ওপর কেউ একটি শব্দও করবে না। সকলে দর্শকের মত দাঁড়িয়েছিলেন। মা নেহালের কাঁধে হাত রেখে চোখের ইশারায় যা বললেন, তারমানে এই দাঁড়ায়- বাবা যা বলছেন শোন। বাবা সবদিক বিবেচনা করেই বলছেন। এই সরলতার কাছেই নেহাল বারবার নত হয়ে যায়।
সেই যে ব্যবসায় ঢুকল, আর কোনও দিকে ফিরে চায়নি। নিজেকে উন্মুক্ত করে সেখানে ঢেলে দিয়েছে। শিখে নিয়েছে, কিভাবে ক্লায়েন্টদের ভালবেসে চলতে হয়। ফ্ল্যাটগুলো বেশিরভাগই দক্ষিণ কলকাতায়। ফ্ল্যাট কেনাবেচার জন্যে অসংখ্য দালাল ছেয়ে গেছে সমস্ত শহর জুড়ে।
একটা নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এ ব্যবসাটিতে এগিয়ে এসেছেন আজকাল অনেকেই। আর আসবেন না-ই বা কেন, প্রায় বিনা পুঁজির ব্যবসা। চাদ্দিকে যেন দালালগুলো মৌমাছির মত ভনভন করছে। এদের এড়িয়ে যাওয়াও খুব সহজ নয়, নেহাল এতদিনে ঠিক তা বুঝে গেছে।
নেহালের দাদু দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত। নদীয়ার এক গ্রাম থেকে এসে উত্তর কলকাতায় উঠেছিলেন নিজের মামার বাড়িতে। তখন তার বয়স কত হবে এই তিরিশ-বত্রিশ! তরুণ দেবজ্যোতি সেই সময় সামান্য পুঁজি নিয়ে তৈরি করেছিলেন ইঁট, বালি সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। সেই ব্যবসাটিকেই তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন একা হাতে। অসম্ভব অধ্যাবসায় তাঁর। এ ব্যবসাকেই তিনি ধ্যানজ্ঞান করে তুলেছিলেন। নেহালরা এখন যে বাড়িতে থাকে তা দেবজ্যোতির-ই ফোঁটা ফোঁটা ঘাম রক্ত দিয়ে গড়া। এই শ্রমের অবমাননা একটুও করতে দেননি মানবজ্যোতি। বুক দিয়ে আঁকড়-ধরে আছেন সমস্তটা। তিনি চান তাঁর ছেলেরাও এ ব্যবসাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাক, আরও সামনের দিকে। মাঝে মাঝে খুব চিন্তায় পড়ে যান মানবজ্যোতি, যদিও তাদের ব্যবসা এখন রমরমা। কিন্তু ব্যবসা মানেই তো ওঠাপড়া, রোজকার এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ জয়ের নেশা তিনি তার বাবার থেকে পেয়েছেন। সময়ের তাপে পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিজেকেই পাথর করে নিয়েছেন। এখন আর তাঁকে কোনও রোদ তাপ ছোঁয় না। নেহাল দেখেছে তার বাবাকে, কি কঠোর হাতেই না ব্যবসাটিকে ধরে আছেন তিনি। ইচ্ছে করলেও ওই রকম করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে না ও-কখনও। যতই এ ব্যবসাটিতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখুক না কেন! ও-তো অন্যরকম একটা জীবন চেয়েছিল, যা আরও সম্মানের। এখানেও সম্মান আছে, কিন্তু সবই যেন ভাসা ভাসা অর্থের বিনিময়ে পাওয়া।
অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল নেহাল। এসবই তো সত্যি। এখন নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছে। সামনের একটা দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। রোদ্দুর ক্রমশ উচাটন দিয়ে উঠেছে। কলেজ স্কোয়ারের এ বিশ্রামাগারটির ছায়ায় অসংখ্য লোক নিজেদের এলিয়ে দিয়েছেন, পরম নিশ্চিন্তে। কালো জিন্সের পকেটে কেঁপে উঠল মোবাইলটা। এসএমএস। নীলাম্বরীর।
“Ki re kothay? Aaj chhuti niyechhi, Baddo ekgheye lagchhilo. Thik korechhi aaj saradin ghumiye katabo.”
নেহালের ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। মুহূর্ত অপেক্ষা না করে উত্তরে লিখল,
-College square-e.
-chole aay.
-Aaschhi.
যেন এমন একটি সময়ের-ই অপেক্ষায় ছিল। আজ ছন্দহীনতা পেয়ে বসেছে। নীলাম্বরী! এক কলেজে, এক-ই সাবজেক্টের স্টুডেন্ট না হলেও খুব কাছের ছিল। অথচ এই নীলাম্বরীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিলনা টানা দশ বছর। দশ বছর আগে মধ্যবিত্তের হাতে এত মোবাইল ফোনের রমরমা ছিল না। আর ঠিকানা নেয়া, চিঠিপত্র দেয়া এসবও হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলতে কি এই নেহাল তখন ডুবে গিয়েছিল অদ্ভুত এক হতাশার যন্ত্রণায়। উচ্চ শিক্ষা করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। যদিও বাইরে তা কখনও ফোটেনি, তবুও এক গভীর স্তব্ধতায় অভিমানে হয়তো প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকেও নিজেকে ছিন্ন করে রেখেছিল। অথচ ভালো বন্ধু তারা। এখন নীলাম্বরী একটা নামকরা দৈনিকের বিনোদন সাংবাদিক। ছুটতে হয় প্রতিটি সেকেণ্ড হিসেব করে, মাথায় রেখে। কলেজের সেই ছিপছিপে শ্যামবর্ণা মেয়েটি এখন মোটা হয়েছে বেশ। এসব পরিবর্তনের পরেও নেহালের চিনে নিতে একটুও ভুল হয়নি।
নীলাম্বরী কাগজের জন্যে একটি স্টোরি করতে তাদের অফিসে এসেছে সেদিন। নীল রঙের জিন্স আর গোলাপি রঙের একটি কুর্তিতে অপূর্ব দেখতে লাগছিল। কোলাপসেবল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠল নেহালকে দেখে।
-আরে, নেহাল না?
– নীলাম্বরী! কোথায় এতদিন ঘাপটি মেরে ছিলি?
নীলাম্বরী স্মিত হাসে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। বলে,
-কলেজ শেষ করেই শান্তিনিকেতন চলে গেছিলাম, বিশ্বভারতী থেকে এম.এ করতে। তারপর তো কলকাতার সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ-ই ছিল না।
-বাপরে! তার জন্য একেবারে অজ্ঞাতবাস! তোর মনে আছে, আমি তুই আর মহুল নিজেদের এবেলা ওবেলা না দেখে কেমন হাঁপিয়ে উঠতাম!
-তা-আর থাকবে না। আচ্ছা, বিয়ে করেছিস?
-এরকম হতচ্ছাড়ার হাতে কে পাত্রী দেবে? তুই করেছিস?
-এক-ই কেশ বস।
দু-জনেই হেসে উঠল এবার।
-বল কী মনে করে?
-সেটি পরে আলোচনা করে নিলে-ই চলবে। এখন চল, মানে যদি তুই খুব ব্যস্ত না থাকিস তবে আমরা একটু বাইরে কোথাও গিয়ে বসতে পারি!
-ওকে। তোর ইচ্ছে।
অফিস থেকে বেরিয়ে সেদিন একটি রেস্টুরেন্টে অনেকক্ষণ সময় কাটাল দু-জনে।
চোখের সামনে উথলে উথলে উঠল পেছনের সারিতে ফেলে আসা সেইসব দিন, মুহূর্তগুলো। আসলে সময় তো এমন-ই। ফাঁকা পৃষ্ঠাদের ছেড়ে দিতে হয়, কখনও সামনে পিছনে কিছু না-ভেবেই। ভুলে যেতে হয়। কিছুটা সময়কে পুনরায় আরও শক্ত মাটির ওপর নিজেদের নির্মাণ করার জন্যে। কত না বলা শব্দ-বাক্য জমে যায় বুকের ভেতরটিতে।
নীলাম্বরীর সঙ্গে পুনরায় দেখা হওয়া, নিজেদের কাছে যাওয়ার বয়স প্রায় দু’বছর। এই দু-বছরে নিজেরা নিজেদের অনেক কাছে এসেছে। নিজেরা নিজেদের বুঝে নিয়েছে একে অপরকে। বিয়ে তো একটা কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন। এ বন্ধন তো কেবল লোককে জানানো। সমাজকে জানানো যে, দ্যাখো, আমরা একসঙ্গে হলাম অকাট্য বন্ধনে!
আসলে নিজেদের ভেতর ভালবাসা থাকলে আর কিছু-ই প্রয়োজন নেই।
নেহাল ভবানীপুরের এই পাড়াটিতে আসলে কেমন এক আত্মীয়তার গন্ধ পায়। এই গন্ধটি কলকাতা শহরের আর কোথাও-ই পাওয়া যায় না। আসলে কিছু কিছু টান থাকে শেকড় থেকে নির্গত। আর নেহাল যে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, সেখানে কেবল শেকড় ওপড়ানো, তা নিজের হাতে না করলেও। এইসব শেকড়গুলো উপড়ে যখন বহুতল বাড়ি (যার পোশাকী নাম ‘ফ্ল্যাট’) ওঠে, ওগুলো এক একটি সব নতুন গ্রহ যেন। সেখানে মানুষ খাঁচায় বন্দি পাখির মত এপাশ ওপাশ করে। এইসব মানুষদের দেখলে নিজের অত্যন্ত অপরাধী মনে হয়। নিজেকে মনে হয় যেন, এ পৃথিবীর নগণ্যতমজীব! ভবানীপুরের এই পাড়াটি সেই দিক থেকে নেহালের আত্মার বাঁধনে বাঁধা আছে। এখানে নীলাম্বরী থাকে। তাই বুকের অলিন্দে অন্যরকম একটা টান তো থাকেই।’
নীলাম্বরীদের বাড়িটা দো-তলা। বাড়িটার চারপাশ সীমানা বরাবর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা টবে টবে অসংখ্য গ্রীষ্মের ফুল। একটি টবে সুন্দর পাতিলেবুর গাছ। ছোট ছোট লেবু এসেছে গাছটিতে। এছাড়াও পাঁচিলের চারপাশে অসংখ্য গাছ, সবুজে মুড়ে রেখেছে বাড়িটিকে। নেহাল গেটে নক করতে-ই নীলাম্বরী দরজা খুলল।
-কী রে! নিজেকে আজ আবদ্ধ করে রেখেছিস যে বড়?
-সারা মাস যা গেছে, আর শরীর টানছিল না।
-কাকু-কাকীমার কোনও শব্দ পাচ্ছি না যে?
-খড়গপুর গেছে! মাসিমণির ওখানে।
-তাই কী এই নির্জন যাপন!
-মানে?
-মানে আর কিছুই না। শত পুষ্পের ন্যায় পাপড়ি মেলিয়া…
-ছাড়তো রসিকতা, চল ওপরে চল।
-আচ্ছা, আমরা কি বিয়ের পরেও তুই তুকারি চালাব, কি ভাবছিস?
-ক্ষতি কী?
-ক্ষতি কিছু-ই না। আমি সেই যে সকালে বাইক নিয়ে বেরিয়েছি, তা তো লাভ-ক্ষতির হিসেব না করে-ই।
-তোকে তো আমি চিনি, তারমানে সারাদিন কিছু খাওয়াও হয়নি নিশ্চয়?
-হ্যাঁ, হয়েছে তো ঘোষ কেবিনা চা, আর এক প্যাকেট সিগারেট।
-ওফ! নেহাল তুই আমাকে পুরো পাগল করে ছাড়বি। তোকে না কতদিন বারণ করেছি এভাবে খালি পেটে না থাকতে। কতবার বলেছি, সিগারেটটা ছাড়। স্নানও নিশ্চয় হয়নি?
নেহাল অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,
-না।
নীলাম্বরী এখন যেন একদম অন্য একটি মানুষ। নেহালের হাত ধরে টানতে-টানতে সিঁড়ি থেকে নেমে আসলো। পিঠে ধাক্কা দিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল নেহালকে। নেহালেরও এই ভালবাসার শাসন উপভোগ করতে করতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছিল।
-স্নানটাও কি আমাকে-ই করাতে হবে? ওভাবে জলের দিকে তাকিয়ে আছিস যে?
-দিলে তো ভালো-ই হতো। দে না…
কপট চোখের রাগ দেখিয়ে হেসে উঠলো নীলাম্বরী। বাথরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বলল, জলদি বেরিয়ে আয়। আমি ডাইনিংয়ে খাবার দিচ্ছি। আমার পেটেও কিন্তু ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।
-ছুঁচোটিকে বল, আমি যতক্ষণ না বেরচ্ছি অন্য ফ্রি-হ্যাণ্ডগুলো করতে।
নীলাম্বরী মুখ টিপে হাসলো। নাহ! এর সঙ্গে কথায় পেরে উঠবে না। আজ নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে। এই সুখী জীবনটা কখনও হারাতে চায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবে তার প্রেমকে, নেহালকে।
কেন যে এতগুলো বছর দূরে ছিল নেহালের থেকে! সেই শান্তিনিকেতনের জলবায়ুর মুক্ত পরিবেশেও নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হত। সকলে ভাবত, এই স্মার্ট, ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণা মেয়েটিকে যেন কিছুই ছোঁয় না। কতবার কত মানুষের ভিড়ে তো একমাত্র এ মানুষটিকে-ই খুঁজেছে নীলাম্বরী। নেহালও এক শূন্যের ভেতর দিয়ে নিজেকে মেলে দিয়েছে। বুকের তাপ উত্তাপে পুষে রেখেছে একটি-ই নাম। নীলাম্বরী সবই শুনেছে নেহালের থেকে, কি পরিবেশে জয়েন করতে হয়েছে নিজেদের ব্যবসায়। উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছে-ই চলে গেছিল নেহালের। অনেক বুঝিয়ে সেখান থেকে ফেরাতে হয়েছে। আরেকটি বছর তারপর এম.এ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তখন পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি অন্য একটি ব্যবসা শুরু করবে নেহাল। নিজের মতন করে দাঁড়াবে, সম্পূর্ণ নিজের পায়ে। তবে এই নয় যে, ও-তার বর্তমান কাজটিকে অবজ্ঞা করবে। নীলাম্বরী তা কখনও-ই চায়না। চায়না বর্তমান সময়ে যখন পরিবারগুলো অসংখ্য খণ্ডে-খণ্ডিত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে, তখন ওদের পরিবারটিও ভেঙে যাক। চরম বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়েও নেহালের বাবা মানবজ্যোতি সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর পরিবারকে সত্যিকারের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন। এখনকার চরম বাস্তবের ভেতর দাঁড়িয়েও তিনি ভেঙে যেতে দেননি। মানবজ্যোতির এ-শক্তিটিকে মনের খুব গভীর থেকে সম্মান করে নীলাম্বরী। সে তো এমন সুন্দর সাজানো গোছানো একটি পরিবার-ই চেয়েছিল, সেই কবে। যেখানে আত্ম-সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে থাকবে…
-কি হল, ভাবের ঘরে আর কতক্ষণ? বরটি তো এবার খিদে লাফাবে?
সত্যিই খাবার বেড়ে বসে থাকতে থাকতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল নীলাম্বরী। অন্যমনস্কতা লুকোতে সে বলল,
-তো বর মশাই, এবার খাবারটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।
-যথাজ্ঞা মহারাণী।
খাওয়া দাওয়ার পর শেষ করে দু-জনে ঘরে এসে ঠিক পাশাপাশি বসল। নীলাম্বরীর হাতটি শক্ত করে ধরে বসেছিল নেহাল। নেহালের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেছিল নীলাম্বরী। বাইরে একটি কোকিল ডাকছিল মিষ্টি সুরে। অনেকক্ষণ পর নেহাল বলল,
-সময় কেমন বদলে যাচ্ছে তাই না?
-হুঁম। তা তো বদলাবে-ই। আমরাও কি বদলাই-নি বল?
-সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর সেই লাইনগুলো মনে আছে?
-কোনটা? ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত’…?
-হ্যাঁ। ঠিক তাই। চিরসত্য কথাগুলো।
-কবিতা কখনও মিথ্যে বলে না নেহাল, যদি সেটি হয় অন্তর্নিহিত। এ কবিতাটিও সেই গোত্রের-ই।
-সুন্দরকে তুই যেখানে স্থান দিস না কেন, সে সুন্দর-ই।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচম্বিতে ঠোঁটের লাবণ্যটুকু নেহাল নিয়ে নেয় নিজের ভেতর। নিয়ে নেয় নীলাম্বরীকে এক্কেবারে কাছটিতে। দু-জনে মিশে যেতে থাকে এক গভীর অনুভবে। প্রকৃতির আদিমতর চির ভাস্বর এক অনুভুতি ছুঁয়ে যায় ওদের।
বাইরে কোকিলটি আবার ডেকে উঠল। দু-জনের যেন এখনও ঘোর কাটেনি। নীলাম্বরী বলল,
-জানিস, ও-এত ডাকছে কেন?
-কেন?
– তুই এসেছিস তাই।
নীলাম্বরী আবার মুখ গুঁজে দিল নেহালের বুকে। ওরা এভাবে কতক্ষণ থাকল কেউ-ই জানে না। ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকল নিজস্ব নিয়মে। নীলাম্বরী জানলার বাইরে চোখ রাখে। নেহাল পড়ে নিচ্ছে নীলাম্বরীর চোখের উচ্চারিত ভাষা।
এইতো গড়িয়ে যাচ্ছে রোদ। রোদ গড়ানো বিকেল জুড়ে উপচে পড়ছে মাধুর্যতা। এই অপরূপ সৌন্দর্য্য-ই তো ওদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক সম্পূর্ণতার দিকে। নীলাম্বরী ভাবে, কিভাবে এক আবদ্ধ জীবনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এল নেহাল! এই নেহাল আবার নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখছে। এতদিনে তার উচ্চ শিক্ষার আশা পূর্ণ হচ্ছে। এভাবেই তো এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নে যাতায়াত। এমন করেই তো নীলাম্বরী এগিয়ে যাবে, নেহালকে পাশে নিয়ে এক অন্তহীন জীবনের পথে। কেননা জীবন শেষেও ওরা ফুটে থাকবে দু-জনের হয়ে। জীবনেরই মধ্যে।
Add Comment