সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-ঠাকুর দাস মালো
প্রিয়তমা,
আমি জানি তুমি ভাল নেই তাই কেমন আছো জিজ্ঞাসা করার সৎ সাহস আমার নাই। আমরা এখন অনেক কাছাকাছি থাকলেও দুটো শরীরের যেন যোজন যোজন দূরত্ব। যখন হাজার মাইল দূরে থাকতাম, জানতাম পরবর্তী ছুটিতে না গেলে তোমাকে আর এক নজর দেখা হবে না, যখন তোমাকে আর আমাদের সোনামনিদের দেখার জন্য একমাত্র ভরসা ছিল সিয়ানো কিংবা ব্লু কার্ড, তখনও ঐসব বিভীষিকাময় দিনগুলোও আমার জন্য এত দুঃসহ ছিল না। তখন শুধু শরীরী দুরত্বই ছিল, মনের দুরত্ব তোমার সীমাহীন ভালবাসার কাছে ছিল নস্যি। তোমার ছায়া সর্বক্ষণ আমার পিছু পিছু ছুটে বেড়াত ঐসকল ভাগ্য বিড়ম্বিত ডিঙ্কা আর নূয়েরদের পিওসি হয়ে সেক্টর টু সেক্টরে। যখন দিনের পর দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতাম, হোক শর্ট রেঞ্জ কিংবা লং রেঞ্জ প্যাট্রোল, যখন মিতসুবিসি পাজেরো হাকিয়ে একটানা পাড়ি দিলাম শত শত কিলোমিটার, জানো এতটুকুও ক্লান্ত হতাম না। হতাশা কখনও গ্রাস করতে পারত না কারণ আমি জানতাম দু’দিন পরে হলেও আমি নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসব, আর নেটওয়ার্ক মানেই তোমার সেই চিরচেনা মায়াভরা মুখ, চিরাচরিত প্রশ্ন আমি কত দুশ্চিন্তায় আছি! আমরা ছিলাম অজেয়, দুর্দমনীয়, দুর্দান্ত কারণ আমরা ইউএন ভেটেরিয়ানরা অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। শ্রীলঙ্কার এক আনপোল ইউএন পুলিশ অফিসার রোশন লকু আমাকে বলছিল, ঠাকুর আমরা এখন আর জাতীয় নই আমরা বিশ্ব মানবতার সন্তান। রোশনের কথা মনের কোণে প্রতিনিয়তই বাজে। ফিরে এলাম কিন্তু সত্যিকারের আসা হল না!
আমি কত অসহায় দেখেছো? এখন আমার অফিস আর বাসার দুরত্ব বড়জোর দুই কিলোমিটার, পায়ে হাটলেও সর্বোচ্চ পনের মিনিট, ছায়ার মত সারাক্ষণ ৪জি নেটওয়ার্ক, এক মিনিট কথা বলার ফুরসত পাইনা ভিডিও কলতো কল্পনাই করতে পারি না। আহা রে জীবন! আহা আমাদের সন্তান! আর যাই করি তোমাকে কিংবা ঐ দেবদূতদের আর কত বঞ্চিত করব ? সব কিছুরইতে একটা সীমা আছে! শুধু সীমা নেই আমার কর্মঘন্টার, শুধু সীমা নেই আমার সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের, শুধু সীমা নেই আমাদের নির্ঘুম রাতের। গভীর রাতে যখন বাসায় ফিরে তোমার মুখে শুনি বিন্দু আমার বাবা বাবা করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে, বৃত্ত ঘুমানোর আগে আবদার করেছে বাবা যেন তার গা ঘেঁষে ঘুমায়। মনে হয়, মনে হয় সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিই, বিশ্ব সংসার তছনছ করে দিই, মনে হয় লাইসেন্সড পিস্তলের এক একটা বুলেট মুক্ত আকাশে ফুটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিই, নিজেকে সকল জাল থেকে মুক্ত করে বলি, ও হে সিনিয়রগণ আমি আজ হতে তোমার দাস না, আমি একজন বাবা, আমি একজন স্বামী। সন্তানকে বুকে টেনে তাকে আদর করার অধিকার আমার আছে, স্ত্রীকে সময় দেয়ার অধিকার আমার আছে। আমি আর আমার পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধবদের বঞ্চিত করতে পারব না। আমার আত্নীয় স্বজনদের জানিয়ে দিতে চাই আমি কাউকেই ভুলি নাই। খুব সকালে আবার যখন অগস্তা যাত্রায় বের হই তখনও সোনামনিরা একই কাতে শুয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায়ই থাকে না। হায় রে জীবন! মানবতা এতটা বিপন্ন, যেখানে সন্তানরা শুধু জেনেই যায় বাবা আছে, দুচোখ ভরে আর দেখতে পায় না।
বধুয়া আমার, তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি, আমি বলতে ভুলে গেছি বধুয়া। আমি ভুলে গেছি সব কবিতা, আমি ভুলে গেছি নিজেকে। অন্তঃসারশূণ্য আমি তোমার ব্যথাতুর মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আজ দু’লাইনও আওড়াতে পারি না। তোমার সবচেয়ে পছন্দের কবিতাখানি যা তোমার জন্য আমি আমার মত করে আবৃতি করতাম, তুমি বিমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনতে, সেই প্যারিসের চিঠি বিস্মৃত হয়ে গেছে আজ। শত চেষ্টা করেও আকাশীকে আঁকতে পারলাম না। কত শত ছোট গল্প আর চিঠি, যখন সেন্সর বোর্ড হয়ে একটার পর একট প্রকাশের অপেক্ষায় থাকত, ঐ সকল কবি সত্বা আজ কর্পুরের মত উবে গেছে। ভাবতেই পারি না, গত বিবাহ বার্ষিকীতে তোমার হাতে একটা গোলাপ তুলে দেয়ার সময় পেয়েছি কা না। একটা চিঠি, গল্প বা কবিতা লিখতে পারিনি। ভাবতেই পারি না তিন বছরের জোনাকির জন্মদিনে একটা মোমবাতি জ্বেলে বলতে পারিনি মাগো পরের বার,,,,,,,
অন্তর্যামিনি, তবু জোর গলায় বলতে চাই ভালবাসি তোমাকে, প্রবল চিৎকারে বলতে চাই তোমাকেই শুধু তোমাকেই ভালবাসি। ক্ষমা করে দিও তোমার পাগলুটাকে।
ইতি
তোমার সে, যে তোমার একান্ত আপন ছিল, আপনই থাকবে।
Add Comment