গল্প

করোনায় ঢেকে গেলো ঐতিহ্যের বৈশাখ

এসো হে বৈশাখ…

-শিউলি মন্ডল

রবী ঠাকুর বহু বছর আগে হয়তো আজকের দিনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নি স্নানে সূচি হোক ধরা”…

এই লাইনের যথার্থতা আজ বুঝতে পারছি। জীবনে কখনো এরকম পহেলা বৈশাখ পালনের অভিজ্ঞতা হবে তা হয়তো কেউ কখনই কল্পনা করেনি। আজ এই সময়ে একটি পবিত্র অগ্নি স্নান পৃথিবীর জন্য বড় দরকার। যে অগ্নি দাহে পৃথিবী থেকে দূর হবে করোনা নামক অদৃশ্য ঘাতক।

“পহেলা বৈশাখ ” বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। যেখানে ধর্ম-বর্ণ, উচু-নিচু, জাতপাত নির্বিশেষে সবাই প্রাণ খুলে অংশগ্রহণ করে। বাঙালির কাছে পহেলা বৈশাখের বর্ণনা দেয়া নিতান্তই বোকামি। তাও একটু লিখতে ইচ্ছে করছে আজকের বিশেষ দিনের জন্য।

জন্মসূত্রে গ্রামে বেড়ে ওঠা। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছি কত বৈচিত্র আর রঙিনভাবে সেজে ওঠে সবার পহেলা বৈশাখ। গ্রামের বৈশাখ মানে ভিন্নতা। চৈত্রের শেষেই আসে বৈশাখ। অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি। এসময় এখানে আয়োজন ও উৎসাহের কোন কমতি থাকে না। গ্রামের বিভিন্ন যায়গায় চৈত্র সংক্রান্তি ঘিরে আর বৈশাখ উপলক্ষে শুরু হয় মেলা। প্রায় সবার ঘরে বছরের প্রথম দিনে, প্রথম ধানের চাল দিয়ে রান্না হয় নবান্ন। সকালের পান্তা -ইলিশ খাওয়া তারপর ঘুরতে যাওয়া। হিন্দু ধর্মের অনেক রকম প্রথার মধ্যে, এই দিন দল বেঁধে সারা বছরের শুভ কামনায় বাড়িতে বাড়িতে কির্তন করতে যাওয়া একটা অন্যতম বিষয়। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভালোলাগা, আমেজ আর সৌহার্দ্য থাকে বাঙলার ঘরে-ঘরে।

মানুষের জীবনের সাথে সাথে প্রকৃতিও সাজে নতুন ভাবে। চৈত্রের দাবদাহ শেষে বৈশাখের ঝড়ো হাওয়া বয়ে আনে প্রশান্তি। সেসব কথাগুলো আজ অতীত। এটা ভাবলেও বুকটা কেঁপে উঠছে। কারণ আজ এর কিছুই ঘটছে না। ভবিষ্যতটা কেমন হবে সেটাও জানিনা। কারণ ভবিষ্যত দেখার জন্য পৃথিবীতে থাকব কিনা সেটাই অনিশ্চিত। এই আতঙ্ক আজ সবার চোখে মুখে স্পষ্ট। করোনা নামের আতঙ্কে ঢেকে গিয়েছে সবার মুখের উচ্ছলতা। আজ মেলার মাঠটা খালি। চৈত্রের শেষে আকাশে উড়ছে না রঙিন সব ঘুড়ি। কারো উঠোন মুখরিত হচ্ছে না কির্তনের ধ্বনিতে। কেউ কেউ হয়তো নিতান্তই ঘরে বসে নিজের মত করে খাচ্ছে পান্তা -ইলিশ। আর প্রার্থনা করছে যাতে দেখতে পারে আগামীর বৈশাখ।

তবে এই বৈশাখটা হয়তো পুরোটাই প্রকৃতির একান্ত নিজের। আজকের বৈশাখ নদীর জলের, গাছের পাতার, ফুল -পাখির। হয়তো তারা আজ কথা বলছে নিজেদের সাথে। তাদের বিরক্ত করছে না মানুষ নামের জীবটি। বড় নিশ্চিতে, র্নিবিঘ্নে মেলে ধরেছে তাদের আপন রুপ বৈচিত্র।

আজ তুলনা করা দুষ্কর, বিশ্ব জোড়া লাশের গন্ধ কি ম্লান করে দিচ্ছে প্রকৃতির রুপ। নাকি প্রকৃতির বৈচিত্র ছাপিয়ে যাচ্ছে মানুষের আর্তনাদ। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, আর সচেতন হয়ে ঘরে থাকার সময়। আমাদের সাবধানতা আর সচেতনতাই পারে আগামী বছর এই প্রকৃতির বৈচিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে, নিজেদের বৈচিত্র্যময় করে তুলে পহেলা বৈশাখ পালন করার সুযোগ দিতে। আর যদি সচেতনত না হন তাহলে হাজার বছরের মধ্যে এবারের এই ঐতিহাসিক পহেলা বৈশাখের সাথে, নিজের জীবন বিষর্জন দিয়ে হতে পারেন একটি অলিখিত ইতিহাস। তাই প্রার্থনা করব এই অকালে নিজে ইতিহাস না হয়ে, এই কঠিন যুদ্ধ মোকাবেলা করে একটা ইতিহাসের সাক্ষী হন। সবাই ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন, অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930