-নিশীতা মিতু
করোনা লড়াইয়ে জিতলেও মধ্যবিত্ত হারবে ‘অর্থের’ লড়াইয়ে
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। সরকার যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করায় এখনও অব্দি লাগাম টেনে রাখা গেছে আক্রান্তের সংখ্যায়। তবে তা কতদিন স্থায়ী হয় বলা মুশকিল। করোনার বিস্তার প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করার পাশাপাশি নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টিন বা ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
এই লক্ষ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এ ছুটি এবার বাড়ল ১১ এপ্রিল অব্দি। অর্থাৎ আরও এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ দিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে ১৭ মার্চ থেকে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কর্মজীবী মানুষরা হয়ে পড়েছে কর্মহীন। তাদের ওপর নির্ভরশীল নিম্ন আয়ের মানুষরাও হারিয়েছেন কাজ কিংবা আয়ের উৎস। সব মিলিয়ে করোনার বড় একটি ধাক্কা গিয়ে লেগেছে অর্থনীতির দেয়ালে।
করোনা ও বিশ্ব অর্থনীতি
পুরো পৃথিবী আক্রান্ত এই করোনা ভাইরাসে। প্রায় প্রতিটি দেশেই বন্ধ রয়েছে কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত। বিশ্বজুড়ে বন্ধ রয়েছে পর্যটন শিল্পজনিত সবকিছু। মাত্র তিন মাসেই অর্থনীতির চাকা ঘুরে গেছে উল্টো দিকে। ইতোমধ্যে ভয়াবহ ধসের মুখে পড়েছে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক প্রধান ডেভিড উইলকক্স আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১০ দিন আগেও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে মোড় নিচ্ছে কি না তা নিয়ে বাস্তব অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু এখন আর তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।’
অর্থাৎ নিশ্চিত মন্দার মুখোমুখি বিশ্ব অর্থনীতি। এর আরেকটি দিক হলো চাকরির বাজার। করোনার কারণে এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে এক নাজুক অবস্থার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মতে, মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।
করোনা পরবর্তী সময়ে কী হবে বৈশ্বিক অর্থনীতির হাল কিংবা কতদিনেই তা সামলানো যাবে তা নিয়ে চিন্তিত অর্থনৈতিকবিদরা। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এর অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক রিচেল ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার অর্থনীতিকে যে সংকটে ফেলেছিল, করোনা ভাইরাসের কারণে সেরকম সংকট দেখা দিতে পারে। এমনকি দেখা দিতে পারে মহামন্দা।’এর থেকে অন্তত এ কথা পরিষ্কার হচ্ছে যে খুব জলদিই অর্থনীতিতে শুভ দিন আসবে না।
অর্থনীতির বড় কোপ মধ্যবিত্তের ঘাড়ে
কী চমকে উঠলেন? ভাবছেন হয়তো ভুল লিখেছি। কারণ, বিশ্বজুড়ে সবাই বলছে করোনার কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হবে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে নিম্নবিত্তদের ওপর। তবে কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলে দেখবেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কষ্টে থাকা মানব শ্রেণী হলো নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
প্রেক্ষাপট ১ : ঢাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকে মাজেদুল হক (ছদ্মনাম)। একটি ছোট কাপড়ের ব্যবসা তার। তা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকমে চলে যায় সংসার। করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে। পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে ঋণ করে পণ্য এনেছিলেন। ব্যবসায় ধস তো নেমেছেই তার মধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। সঞ্চয় বলতে অল্প কিছু অর্থ রয়েছে যা প্রায় শেষের দিকে। এ দিকে নতুন মাস এসেছে। বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন ৫ তারিখের মধ্যেই যেন ভাড়া পরিশোধ করেন। বাসা ভাড়া, খাবার, বিদ্যুতের বিল সবকিছু কোথায় থেকে জোগাড় করবেন জানা নেই তার।
প্রেক্ষাপট ২- একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করত হাসিব জুবায়ের (ছদ্মনাম)। করোনা পরিস্থিতির কারণে কোম্পানিটি সকল কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সাবলীল না হওয়া অব্দি কোম্পানি চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাসা ভাড়া, গ্রামে মা-বাবাকে হাত খরচ পাঠানো সবকিছুই আঁটকে গেছে তার। এই পরিস্থিতির শেষ কোথায় সেটিই এখন ভাবার বিষয়।
লকডাউনের প্রভাবে কর্মহীন হয়ে যাওয়া নিম্নবিত্তদের পাশে এরই মধ্যে দাঁড়িয়েছে সমাজের নানা স্বেচ্ছাসেবী দল। প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী কিংবা অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করছে তাদের। একটু খেয়াল করে দেখুন। সমাজের উচ্চবিত্তদের কারও কাছে সাহায্য চাইতে হয় না কারণ তাদের অবস্থা যথেষ্ট উন্নত, নিম্নবিত্তদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে উচ্চবিত্তরা। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কাউকে না পারে কিছু বলতে, না পারে সইতে।
মরার ওপর খাড়ার ঘা ‘বাসা ভাড়া’
একে তো হঠাৎ কাজ বা উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়া, তার ওপর বাড়িওয়ালাদের প্রদত্ত চাপ। এ যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা। নিন্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বেশি পরিবারের না বলা সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা এখন বাসা ভাড়া। ঢাকায় বসবাসকারী সালেহা খানম। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি স্বামী বর্তমানে কাজ হারিয়ে ঘরে। সালেহা বলেন, ‘আমাদের কাছে তো আর কারও সাহায্য আসে না, আমরাও কারও কাছে হাত পাততে পারি না। তিনবেলা না খেয়ে না হয় একবেলা খাচ্ছি কিন্তু বাসা ভাড়া জোগাড় করবো কীভাবে?’
একই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য ভাড়াটিয়া। কিছু বাড়িওয়ালা অবশ্য এক মাসের ভাড়া মওকুফ করেছেন, তাদের নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনাও হয়েছে বেশ। তবে এ সংখ্যা একেবারের নগণ্য বলা চলে। সমাজের নানা স্তরের মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনের নানা ব্যক্তিত্ব বাড়িওয়ালাদের অনুরোধ করেছেন ভাড়া মওকুফ কিংবা ৫০ শতাংশ কম নেওয়ার জন্য। তবে এই অনুরোধ কানে কি আদৌ তুলছে কেউ? সারাজীবন আত্মসম্মানবোধ নিয়ে কোনোরকমে জীবন কাটানো ব্যক্তিটিকে যদি ভাড়া না দেওয়ার অপরাধে বাড়ি ছাড়া হতে হয় তবে তার দায়ভার নেবে কে?
মানুষ মানুষের জন্য, বিপদে মানবিকতার পরিচয় দেওয়াই মানুষের ধর্ম। পুরো পৃথিবীই স্থবির হয়ে পড়েছে করোনার কারণে। করোনার সঙ্গে লড়াই করে হেরে না গেলেও অর্থের সঙ্গে লড়াই করে যদি কাউকে হেরে যেতে হয় তবে কি তা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না? আসুন নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই, যারা বাড়িওয়ালা আছি তারা এই দুর্দিনে ভাড়াটিয়াদের একটু সাহস যোগাই। আমরা সবাই মিলেই তো সমাজ।
তথ্য: দৈনিক অধিকার
Add Comment