হ্যালোডেস্ক
আল্লাহ তায়ালা কাবা শরীফকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের মিলনস্থান হিসেবে ঘোষণা দেয়ায় এটি এখন সারা পৃথিবীর মুসলমানদের ধর্মীয় রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ভাষ্য মতে, বর্তমান কাবা ঘরটি যেখানে স্থাপিত, সে স্থানটিই পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে ধীরে ধীরে ভরাট হতে হতে এই ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক মহাদেশ। এভাবেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় সাত মহাদেশ। ভৌগোলিকভাবে গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থানে অবস্থিত এই পবিত্র কাবা ঘর আল্লাহ-তায়ালার জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দু’শো কোটি মুসলিম এই কাবাঘরের দিকেই মুখ করে সালাত আদায় করেন। প্রতি বছর হজ ও ওমরার সময় পবিত্র এই ঘরকে ঘিরেই চলে মুসলিমদের প্রদক্ষিণ।
এত সম্মানিত এক ঘর, এর যেমন রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, তেমনই সহস্র বছর ধরে বিস্তৃত এক ইতিহাস আছে এর দরজারও। নিচের ছবিটিই দেখুন না। এখানে যে দরজা দেখতে পাচ্ছেন, সেটি আজকের লেখার আলোচ্য কাবা শরীফেরই দরজা, যা সংযোজন করা হয় ১৯৭৮ সালে। চমৎকার নকশায় সজ্জিত এই দরজার ডিজাইনার সিরীয় এক ইঞ্জিনিয়ার, নাম মুনীর আল জুন্দি। গত শনিবার অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির স্টুটগার্টে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
সিরীয় এই ইঞ্জিনিয়ারের সম্পর্কে জানতে গিয়েই জানা গেল কাবা ঘরের দরজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসও।
হযরত ইব্রাহিম (আ) যে কাবাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে আলাদা করে কোনো দরজা ছিল না। তবে দুটো প্রবেশপথ ছিল। মানুষজন পূর্বদিক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম দিয়ে বেরিয়ে যেত।
ধারণা করা হয়, কাবায় প্রথম দরজা লাগানোর ব্যবস্থা করেন ইয়েমেনের রাজা তুব্বা, ৪র্থ শতকের শেষভাগে। তিনি ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কাঠের তৈরি সেই দরজাটি ইসলাম-পূর্বই কেবল নয়, ইসলামের শুরুর দিকের দিনগুলো পর্যন্তও টিকে ছিল। তিনি জুরহুম গোত্রের নেতাদের হাতে এই দরজার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে যান।
কুরাইশরা যখন এর সংস্কার করে, তখন পূর্বদিকের দরজাটি মাটির লেভেল থেকে বেশ খানিকটা উপরে স্থাপন করা হয় যাতে যে কেউ যখন-তখন হুটহাট করে পবিত্র এই ঘরে ঢুকে পড়তে না পারে। বিপরীত দিক অর্থাৎ পশ্চিমের দরজাটি একেবারে বন্ধই করে দেয়া হয়।
৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল্লাহ ইবনে আল-জুবায়ের সংস্কার করে দরজাটি লম্বায় ১১ হাত দৈর্ঘ্যের করেন।
কাবার দরজায় পরবর্তী বড় ধরনের পরিবর্তনটি আসে এর প্রায় এক হাজার বছর পর, ১৬৩০ সালে।
১৬২৯ সালের দিকে ভয়াবহ বন্যায় কাবার দেয়ালের অর্ধেক উচ্চতা পর্যন্ত পানি উঠে গিয়েছিল। উত্তরদিকের দেয়াল এতে ধসে পড়ে, বেশ ক্ষতি হয় পূর্বদিকের দেয়ালেরও। সেসময় মক্কার শরীফ ছিলেন মাসুদ ইদ্রিস বিন হাসান। ওদিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে তখন সুলতান ৪র্থ মুরাদ। মাসুদ ইদ্রিস তাই সুলতানের কাছেই বার্তা পাঠান কাবাগৃহ সংস্কারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে। সবকিছু জেনে সুলতানও বসে থাকলেন না। তিনি মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলী আল আলবানীকে নির্দেশ দিলেন অনতিবিলম্বে সংস্কারের কাজ শুরু করতে। পাশাপাশি তিনি একদল প্রতিনিধিকে মক্কায় পাঠালেন যাতে তারা এই সংস্কারকাজ তদারক করতে পারেন।
ইঞ্জিনিয়াররা জানাল, পূর্বদিকের দেয়াল এতটাই পুরনো আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, এটাকেও আর রাখার উপায় নেই। এই দেয়াল ভেঙে নতুন করে গড়াই হবে একমাত্র সমাধান। আগের দরজাও ছিল পূর্বদিকে। ফলে দেয়াল ভাঙার সাথে সাথে নতুন করে দরজা বানানোরও প্রয়োজন দেখা দেয়। সুলতান মুরাদ মিশরীয় ইঞ্জিনিয়ারদের নির্দেশ দিলেন কাবার জন্য নতুন দরজা বানাতে। তবে সেই দরজার ডিজাইন যেন আগের দরজার মতোই হয় সেটাও নিশ্চিত করতে বলেন তিনি। তার নির্দেশ মোতাবেক ১৬২৯ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে পরের বছরের মার্চ মাসে শেষ হয় কাবা শরীফের নতুন দরজার কাজ।
বলে রাখা ভাল, এবারের দরজাটি তৈরিতে মিশরীয় ইঞ্জিনিয়াররা বেশ কারিগরি দক্ষতা দেখান। তারা দুই পাল্লায় ভাগ করে দরজায় বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তোলেন, যা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় প্রায় ৯০ কেজি রুপা। পাশাপাশি স্বর্ণের বিভিন্ন নকশাও ছিল। উচ্চমান ও সহনক্ষমতার ধাতব পাত ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে পরিবেশগত কারণে দরজার ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা যায়। প্রথমবারের মতো রুপা ও স্বর্ণের সাহায্যে তৈরি কাবার এই দরজা টিকে থাকে পরবর্তী তিন শতক ধরে।
এর পরের পরিবর্তন আসে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। রাজা আব্দুল আজিজ (পশ্চিমে যিনি ‘ইবনে সৌদ’ নামেই পরিচিত) এর কাছে খবর পৌঁছাল যে দরজাটি নড়বড়ে হয়ে গেছে। ফলে তিনি এর সংস্কারের নির্দেশ দেন ১৯৪৪ সালে। পরবর্তী তিন বছর ধরে চলে এর নির্মাণকাজ। ১৯৪৭ সালে ৩১৭ বছর পর পাল্টানো হলো কাবার দরজা। এবারের দরজাটি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি করা হয়, যার সাপোর্ট হিসেবে আবার লোহার বারও ছিল। পরবর্তীতে এর উপর রুপার পাত দিয়ে তার উপর আবার স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া হয়।
সর্বশেষ পরিবর্তন আসে ১৯৭৮ সালে। ’৭৭-এ তৎকালীন সৌদি রাজা খালিদ বিন আব্দুল আজিজ দেখতে পান আগের দরজাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে তার নির্দেশে কাবার দরজার জন্য নতুন ডিজাইন আহ্বান করা হয়। সেসময়ই ডিজাইন জমা দেন মুনীর আল জুন্দি। তার সেই ডিজাইনটি গৃহিতও হয়। ৩.১ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সেই দরজা তৈরিতে সর্বমোট ২৮০ কেজি সোনা ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে আল্লাহ্র গুণবাচক নাম, কোরআন শরীফের আয়াত এবং আরবি প্রবাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক বিভিন্ন টীকাও উঠে এসেছে।
দরজার ডিজাইনার হিসেবে মুনীর আল জুন্দির নামও দরজায় খোদাই করা রয়েছে। দরজাটি বানানো হয়েছিল মক্কারই বিখ্যাত স্বর্ণকার শেখ আহমদ বিন ইব্রাহিম বদরের ফ্যাক্টরিতে। এই ফ্যাক্টরিটি শুধুমাত্র দরজার কাজ করার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। শেখ আহমদ স্বর্ণের এই কারুকাজ শিখেছিলেন তার বাবা শেখ ইব্রাহিম বদরের কাছ থেকে। মজার ব্যাপার হলো, শেখ আহমদের বাবা শেখ ইব্রাহিম বদর আবার যুক্ত ছিলেন রাজা আব্দুল আজিজের সময়ে তৈরি দরজার নির্মাণের সাথে। ফলে বাবা-ছেলে উভয়ের বেলাতেই দুর্লভ এক সম্মানের অধিকারী হবার সুযোগ এসেছিল। ২০০৯ সালের ৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন শেখ আহমদ।
আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন। হ্যালোটুডে’র ইতিহাস বিভাগে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন, আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখা দিয়ে। হ্যালোটুডে আপনার মনের কথা বলে।
Add Comment