মিলন মাহমুদ রবি:
যারা ভ্রমন পিপাসু তারা একবার হলেও বেড়িয়ে যাবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি। যেখানে গেলে আপনার পরিচয় হবে ইতিহাসের সাথে। জানতে পারবেন বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের সম্পর্কে। আরো জানবেন কবির অনেক অজানা কথা। এখানে এলে দেখবেন, বাংলাসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ভাস্কর্য্য, কবিপত্নীর আবক্ষ ভাষ্কর্য্য, ও শ্বশুর বাড়ির দ্বিতল ভবনটি। আর পিঠাভোগে রয়েছে কবিগুরুর পূর্ব পুরুষের নিবাস। এছাড়া চোখে পরবে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের ভবনের পূর্বদিকের উম্মুক্ত প্রাঙ্গণে অবস্থিত ছফেদা তলায় নির্মিত মৃণালীনী মঞ্চ, আছে গ্রাম্য পরিবেশ, আরো নজরে পরবে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্য নিদর্শন শান্তির নীড় মাটির তৈরি বাড়ি (ঘর)। যেখানে এখনও বসবাস করছে মানুষ। ফুল, ফল, সবুজ-শ্যামল ঘন বাগান, সৌম্য-শান্ত গ্রাম, পান-বরজ ও নার্সারি। খুলনা বিভাগে অবস্থিত নোবেল বিজয়ী অমর কবির আদি আত্মীয়তা ছড়িয়ে আছে এ জেলাতে। যা পূর্বে দক্ষিণডিহি রায়বাড়ি নামে পরিচিত ছিলো।
যে ভাবে যাবেন দক্ষিণডিহি:
দেশের যে কোনো স্থান থেকে খুলনা মহানগরীতে এসে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গেলে দক্ষিণডিহি গ্রাম। খুলনা- যশোর মহাসড়কের বেজের ডাংগা বাসস্টপ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার পূর্বে গেলে দেখতে পরবেন গ্রামের ঠিক মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেণীমাধব রায় চৌধুরীর দোতলা ভবনটি। যা রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য বাড়ি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বাড়িটি ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কবিগুরুর পূর্ব আদিনিবাস পিঠাভোগের কুশারী বাড়ির ইতিহাস:
খুলনা জেলার রুপসা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ৫নং ঘাটভোগ ইউনিয়নের অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামে অবস্থিত একটি সুপ্রাচীন গ্রাম। নওয়াপাড়া বিশ্বরোড থেকে ৭কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে প্রাচীন ভৈরব নদীর ১২০মি. উত্তর পাড়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের আদিনিবাস কুশারীবাড়ির অবস্থান। নাম তার পিঠাভোগ! খুলনা আঞ্চলিক প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরীক্ষামূলক সমীক্ষায় পিঠাভোগ গ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের ভিটার ভিত্তিপ্রস্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ভৈরব অববাহিকায় গড়ে ওঠা পিঠাভোগ নামের সুপ্রসিদ্ধ গ্রামটি প্রাচীন কাল থেকেই ঐতিহ্যবাহী। খানজাহান আলী (রহ.) বাগেরহাট আগমনের প্রায় কয়েকশ বছর আগে ভৈরব অববাহিকায় এই প্রাচীন জনপথটি গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক যোগসূত্র থেকে পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ কুশারীদের আবির্ভাব ও গোড়াপত্তন এবং প্রাচীন বসতি বিন্যাস থেকে গ্রামটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে তথ্য মেলে।
খ্রিষ্টিয় চতুর্দশ শতকে কুশারী গোত্রের শাখা-প্রশাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসতী স্থাপন করেন। তারানাথ কুশারীর দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর বংশের আদি পুরুষ। যিনি খুলনা ফুলতলার দক্ষিণডিহি নিবাসী শুকদেব রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করে পীরালি ব্রাক্ষ্ণণ সম্প্রদায় ভূক্ত হয়। “অন্যগোত্রে বিয়ে করার দোষে সাব্যস্ত হয়ে” জাতিচ্যুত হয়ে দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনে বাধ্য হন। কুশারীরা ব্রাক্ষ্ণন ছিলেন বিধায় স্থানীয় রুচিবান মানুষেরা ব্রাক্ষ্ণণ পঞ্চনন কুশারীকে স্ব-সন্মানে ঠাকুর বলে ডাকতেন। এভাবেই তাঁরা কালক্রমে পিঠাভোগ গ্রামের কুশারী থেকে কলকাতার ঠাকুর হলেন। কলকাতার সম্মানীত পঞ্চানন কুশারী ওরফে পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী বংশধর নীলমণি ঠাকুর প্রভূত অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় গিয়ে বিয়ে করেন। জোড়াসাঁকোয় এই বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারেই ১৮৬১ সালে ৮ই মে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জল নক্ষত্র নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বেণীমাধব রায় চৌধুরীর পরিচয় ও কিছু ইতিহাস:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরের নাম বেণীমাধব রায় চৌধুরী। যৌবনে কবি কয়েকবার তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামাবাড়িতে এসেছিলেন। পরিবার থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী সন্ধান ক্ষেত্র হিসেবে তৎকালীন যশোরের ফুলতলা (বর্তমান খুলনা জেলাধীন) এলাকা নির্বাচন করা হয়। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এ বাড়ির গৃহকর্তা রায়চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিনী দাক্ষায়নী দেবীর একমাত্র কন্যা ভবতারিণী দেবী ওরফে পদ্ম ওরফে ফুলি ওরফে ফেলীর সাথে বিয়ে হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বিয়ের পর ঠাকুর পরিবারের প্রথা অনুযায়ী ভবতারিণী দেবীর নাম বদলে রাখা হয় মৃণালিণী দেবী। বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিলো ২২ বছর ৭ মাস, আর ভবতারিণী দেবীর বয়স ছিলো মাত্র ১০ বছর ১১ মাস! রবীন্দ্রনাথ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণডিহির সম্পর্ক হয়ে ওঠে নিবিড়। মৃণালীনী দেবীর পিতা বেণীমাধব রায় চৌধুরী ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এস্টেটের বেতনভূক্ত কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিয়ে করেন দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা সারদা দেবীকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী আর কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর জন্ম এ গ্রামেই। রবীন্দ্র পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের পাঁচপুরুষের শ্বশুরবাড়ি হিসেবেও পরিচিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে মৃণালিনী দেবীর বিয়ের পর রায় পরিবার উন্নত বসতবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। বেনীমাধব রায় চৌধুরীর দোচালা টিনের ঘর ছিল। তাই কবির শ্যালক নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ১৮৯০ সালে দক্ষিণডিহি ‘রায়বাড়ি’ এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বেণীমাধব রায় চৌধুরীর পুত্রদেরও মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারিদের অনুপস্থিতির কারণে ভবনটি অবৈধ দখলে চলে যায়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভবনটি অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়। জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে নামকরণ করা হয় “রবীন্দ্র কমপ্লেক্স” নামে। ২০১০ সালের ২৭ জুলাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিছু সময় হাতে নিয়ে ২৫ থেকে ২৭ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ বেড়িয়ে যেতে পারেন দক্ষিণডিহিতে। কেননা এ দিনগুলোতে নানা আয়োজনে দিনব্যাপী পালন করা হয় কবির জন্মজয়ন্তী ও কবি প্রয়াণ দিবস। কবির স্মৃতিধন্য এ দুই স্থানে কবি প্রেমীদের মিলন মেলা ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই তিনদিন নতুন রুপে সাজনো হয় এবং আনাগোনা থাকে কবি প্রেমীদের!
রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের বসত ভিটায় কবিগুরুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। কবি প্রেমিরা যেখানে আসলে জানতে পারবেন বিশ্বকবির অজানা অনেক ইতিহাস। এছাড়া প্রতিবছর কবির প্রয়াণ দিবস ও জন্মজয়ন্তিতে দিনব্যাপি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ আয়োজনের সময় যে কেউ ঘুরে যেতে পারেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে।
Add Comment