গল্প

গ্রাম দর্শন

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

ঢাকার কাছাকাছি একটি জনপদ। মাকে দেখতে যাওয়ার কারণেই গ্রামের বাড়ি যাওয়া। ওখানে আসলে আর প্রয়োজন নেই। ওখানে কবর না হলেও কষ্ট বা দুঃখের কোনোই কারণ নেই।

জন্ম হয়েছে আমার এই জনপদের সবুজে ঘেরা, নদীসংলগ্ন একটি গ্রামে। শৈশব কৈশরের বন্ধুও এখন তেমন নেই৷ যারা আছে ব্যস্ত যার যার মতো। আড্ডা বা গল্প করার সুযোগ কম।

১৯৭৫ সালে গ্রাম ছেড়েছি উচ্চ শিক্ষার জন্য। ইন্টারমিডিয়েট থেকে মাস্টার্স করা ঢাকা থেকে। তারপর শিক্ষকতা জীবন শুরু ১৯৮৪ থেকে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবসর জীবন। তারপরও কাজ আর কাজ।

গ্রামের বাড়িতে সেই থেকে মাঝে মধ্যে যাওয়া বাবা মায়ের জন্য। বাবা ২০০৬ এ না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। মা এখনও বেঁচে আছেন। সেই সুবাদে প্রায়ই যাই। মনের টানে নয়, মাটির টানে নয়, শুধু মায়ের জন্য। কারণ, ওখানে রক্তের স্বজন আছে। কিন্তু ওরা নিমকহারাম, বেঈমান, বেয়াদব আর মূর্খতায় আচ্ছন্ন। তাই কষ্ট হয় গ্রামে গেলে। ভুলে যেতে পারলেই মনে হয় ভালো থাকবো। সেসাথে আমার সময়ের গ্রাম নেই। মুরব্বি আর পঞ্চায়েত নেই৷ বিচার নেই। শৃংখলা নেই৷ গ্রামের সৌন্দর্যও নেই। মানুষগুলোও মানবিক নয়। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার দিকে নজর দিচ্ছে না। ক্রমান্বয়ে এক গভীর অন্ধকারের দিকে গ্রাম।

রাজনীতির বিষছোবল আরও নষ্ট করে দিচ্ছে, শ্রদ্ধা ভক্তি আর ভালোবাসার জায়গাটা। মামলা মোকদ্দমা তো আছেই। বনেদী পরিবারগুলো শহরে আস্তানা গেড়েছে। যারাও বা ওখানে আছেন ভালো নেই। এরশাদ সরকার আসার পর থেকেই এই গ্রামের শান্তি নিঃশেষ। মাস্তানের জন্ম। দলাদলি ঘরে ঘরে। জনে জনে। স্বজনে স্বজনে। আপনে আপনে। সেই বিষবৃক্ষ আজ মহীরুহ হয়েছে।

এমন একটি শান্তির গ্রাম ভালো নেই। ভালো থাকার লক্ষণ নেই৷ আমাদের যাতায়াত ঘনঘন হলেও একসময় সুবিধাবাদী গোষ্ঠী চিন্তায় পড়বে। ষড়যন্ত্র করবে। তাই গ্রামীণ জীবনের প্রকমত সুখ আর সমৃদ্ধি সুদূরপরাহত বলেই মনে হয়। সাধারণ ঘরের লোকটিও রাজনীতির ওপরমহলে আশ্রয় প্রশ্রয় পাচ্ছে অন্যায্যভাবে। তাদের হাতে সবসময় বন্দি সাধারণ ও অভিজাত শিক্ষিতজন। এমন একটা দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে আশাহীন হওয়া বৈ বিকল্প দেখি না। নদীর পাড় দখল হয়ে যাচ্ছে৷ পাশেই বিশাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, এখানকার মানুষজনকে আরও জটিল মানসিকতার দিকে ঠেলে দিবে।

এমন করে যদি সবগুলো গ্রাম নষ্ট আর রাজনীতির ভয়ানক দাবার গুটি হয়, তাহলে আগামীর বাংলাদেশ সভ্যতা হারাবে। শান্তি স্বস্তি হারাবে। থানা পুলিশ, প্রশাসনও গভীরে যাচ্ছে না। কারণ, দুষ্টু রাজনীতি সকল সুস্থ চিন্তা গিলে খাচ্ছে৷ মাদকের ভয়াবহ ছোবল ক্রমেই সমাজকে শেষ করে দিয়েছে। আগামী বলে কী আছে, আমার জানা নেই।

সেইসাথে স্বজন আপন আজ ঘরে ঘরে শত্রু৷ কেউ কাউকে মানছে না, গুনছে না। নির্লজ্জতা প্রসারিত। মুরব্বিদের না মানার প্রবণতা প্রবল।

এমন একটা সময়ে গ্রাম আমার সেই ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই৷ গ্রামে বিল্ডি ওঠছে, এটা যদি মনে করা হয় উন্নয়ন, আমি সেই আত্মবিনাশের উন্নয়নের ঘোর বিরোধী। প্রথমেই বলবো, বিশ্বাস আস্থায় ভরপুর আর রাজনীতিবিমুখ একটা সুন্দর গ্রাম চাই। নয় তো গ্রাম হবে জাতি পচে যাওয়ার একটা বিশাল উপাদান। সময় বড় নিষ্ঠুর। সময় মতো মানবিকতা আর আত্মিক উন্নয়নের উদ্যোগ না নিলে, স্বাধীনতা, দেশ, জাতি সকলই স্বস্ব অস্তিত্ব হারাতে বাধ্য।

লেখক, মতি গাজ্জালী

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930