গল্প

ছবির গল্প

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-শাহীন কামাল

সে অনেক কাল আগের কথা। তখন সেলফি কী, ছেলে মেয়েরা জানতো না। এক একটা ছবি তোলা সে সময় এক একটা ঘটনা, ইতিহাস কিংবা প্রাপ্তি। যখন তখন যে কেউ এক ক্লিকেই ছবি তোলা, স্বপ্নেও ভাবেনি। কেউ কেউ শখের বশে আয়েশ করে গ্রুপ ছবি তুলত। কোন স্টুডিও তে গিয়ে স্টাচু অব লিবার্টির মত ‘এটেনশন প্লিজ’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতো। পেছনে পর্দায় আঁকা খাল, বিল, নদী, পাহাড়, পর্বত সবই থাকত। ঘরবাড়ি, রাজপ্রাসাদ আরো কত কী! ঘাড় সোজা করে হাত দু’টোকে শক্ত করে নিচে ছেড়ে রাখা ছবি কিংবা চেয়ারের উপর ভাব নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভংগীতে ছবি তোলা। তখনকার সময়ের ছবি। ছেলেটি তার অতীত স্মৃতির সাথে ছবিটিও গুছিয়ে রেখেছিল। জাগতিক নানা টানাপোড়েন আর স্মৃতির দরজায় সময় অসময়ে অতীত কড়া নাড়লে ছবিটি ভেসে উঠে। ছবির মতোই রংহীন ফ্যাকাসে জীবন যা কিনা একসময়ে সাদাকালোতেও ছিল আলোতে ভরা।

গ্রামের নাম চর সকিনা। তার একেবারে সর্ব পশ্চিমে তিনপাশ খালে ঘেরা বাড়ির পূর্ব ভিটায় ছেলেটির জম্ম। দক্ষিণে অবারিত ফসলের মাঠ। শেষ প্রান্তে তাকালে আবছা ঘোলাটে দৃশ্যের পর লোকালয়। গ্রীষ্মের এই কাঠফাটা রোদেও দক্ষিণের হিমেল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কখনও দল বেঁধে পাটি বিছিয়ে দুপুরের তপ্তক্ষণ গাছের নিচেই পার করে দিত। কাঁচা আমের ভর্তার পরসা বসতো সেখানে। বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড় ঘেসেই রাস্তা। খালে বিলের কাদামাটিতে গড়াগড়ি করে শুরু করেছে জীবন। ভরা খালে সাঁতার কেটে চোখদুটি রক্ত লাল হলে পরে বড়রা এসে বকাঝকা করলে বন্ধ হত সে খেলা। মাঝেমাঝে মাছ ধরার নামে দাদার সংগী হত ছেলেটি। মাঘ – ফাগুন মাসে শুকনো খালে উপর থেকে পিচ্ছিল পথে নেমে যেত খালের তলানিতে। পরনের পোশাককে গুটিয়ে এ খেলা চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। আজও বড় ছেলে স্বপ্ন যখন সরকারী স্কুলের মাঠে রাইডারে উঠে পিচ্ছিল পথে নেমে যায় তখন বারবার ভেসে আসে সেদিনের ছবি।

গ্রামের হাটে যেত ছেলেটি মাঝেমধ্যে বড়দের সাথে।তেতুলিয়ার পাড়ে নাজিরপুরের হাট। সপ্তাহে দুই দিন নদীর পাড়েই হাট বসত। নদীর শান্ত পানিতে পাল তোলা সারি সারি নৌকার চলে যাওয়ার দৃশ্য মনোহর ছিল। সন্ধ্যেবেলা সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সে নয়নাভিরাম দৃশ্য আজও মনের আকাশে ভেসে ওঠে। তখনও সানসেট বা সান রাইজের মত শব্দের সাথে তার পরিচয় হয়নি। দিনের সকল আলোকে পুটুলি বেধে সূর্যের নদীবক্ষে চলে যাওয়ার রূপ দেখেছি অবাক নয়নে। প্রকৃতি তার আপন হস্তে যেন পশ্চিমাকাশ অলংকৃত করেছে। সন্ধ্যাবেলা মাছ আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বড়দের সাথে বাড়ি ফেরা। হাটের বাহারি খাবার নিয়ে কখনও ভেজাল কিংবা অস্বাস্থ্যকর বিষয়ে ভাববার সময় হয়নি।

প্রাথমিকভাবে লেখাপড়া বাড়িতেই শুরু হয়। সকাল সন্ধ্যায় মা বাবার কাছে আলিফ, বা, তা, ক, খ, a b c পাঠের মাধ্যমেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এক সময় বাবার সাথে স্কুল শুরু হয়। শিক্ষক পিতার স্কুলে ছেলেটিকে ভর্তি করা হয় প্রথম শ্রেণিতে। গ্রামের মেঠো পথে দীর্ঘ এবরোথেবরো রাস্তা হেটে স্কুলের যাওয়ার স্মৃতি, আজো বিস্মৃত হয়নি। বৃষ্টিতে ভেঁজে এত লম্বা পথ পাড়ি দিতে শুধুই বই খাতার কথাই ভাবা হত। কোনমতে জামার মধ্যে বইখাতা গুঁজে দৌড়ের স্মৃতির সাথে যেন আজো নিত্য দৌড়াচ্ছে।

এর পর কতই না পথ চলা!! মাষ্টার সাহেবের পুত্র (!) নিজেও আজ বাবার পেশায়। চাকুরীর খোঁজে জেলা শহরে এসে কলেজ জীবনের সহপাঠীকে সংগী করে বাস করছে নিজেদের মত। স্বপ্ন আর শায়ানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা। কর্মব্যস্ত জীবনের এই পথচলায় মাঝে মধ্যে ফিরে আসে সে দিনগুলো! সাদাকালো জীবনে হাজারো রঙিন পরশ সুন্দর আর স্বপ্নের। কখনো অগোচরে, কখনো আচমকাই ফিরে আসে সে দিনগুলো বারে বারে।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

April 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930