রকমারি

তারুণ্যই মানুষের সকল ক্ষমতার আঁতুরঘর

ছবি:সংগৃহীত

-বিপ্লব রেজা

মানুষ হলো মহাসৃষ্টির মহাকারিগর ঈশ্বরের স্বয়ং-প্রতিনিধি। জগতে প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিষ্ঠিত বিচিত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রায় সবটারই ব্যবহারের বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে এই মানুষের। তাই মানুষকে ঈশ্বরের ‘বরপুত্র’ বললেও ভুল হয় না। এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে জ্ঞানে-গুণে-দক্ষতায় ও ক্ষমতায় কেউ নেই; আর হতেও পারে না। যুগে যুগে এই মানুষই মহাশক্তিধর রাজা-বাদশা এবং নবী-রাসুল-পয়গম্বর হিসেবে অন্য মানুষের কাছে এসেছেন। নিজেদের শৌর্য-বীর্য দিয়ে তারা তাদের সময়কে চালিত ও প্রভাবিত করেছেন। এই গূঢ় রহস্য বুঝতে পেরেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় লিখেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিমহান…। ’ মানুষ পারে না বা পারবে না এমন কিছু এ জগতে নেই। তবে মানুষের এই অসীম ক্ষমতার প্রাচুর্য তার যৌবনের ‘একান্ত নিজস্ব সম্পদ’। মানুষের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি (আঁতুরঘর) বা লালনক্ষেত্র হলো তার তারুণ্য। আমাদের মানুষের মধ্যে তারুণ্য যাকে স্পর্শ করতে পারেনি- সৃষ্টিতে, উল্লাসে, আনন্দে কিংবা ভাবনায়, তার গন্তব্য বার্ধক্যের চূড়ান্ত নর্দমায়।

কারণ আদর-ভালোবাসার বয়স হলো শৈশব ও কৈশরকাল, যৌবন বা তারুণ্য হলো সৃষ্টির ও আনন্দের এবং আত্ম-ভাবনা ও দিনযাপনের সময় হলো বৃদ্ধকাল বা বার্ধক্য। কবি নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজে স্বার্থনেষী মহলের শতাব্দিব্যাপী গড়ে তোলা ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর  নিয়মের রূঢ় প্রাচীর একমাত্র তরুণরাই ভাঙ্গতে পরে; কারণ তাদের কোনো ধর্ম নেই, তাদের একটি মাত্র ধর্ম- তারা তরুণ। এ কথা তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন একটি বক্তৃতায়। ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে কবি বলেন, ‘আমরা যৌবনের পূজারি, নব নব সম্ভাবনার অগ্রদূত, নব-নবীনের নিশানবর্দার। আমরা বিশ্বের সর্বাগ্রে চলমান জাতির সহিত পা মিলাইয়া চলিব। ইহার প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে যে, বিরোধ আমাদের শুধু তাহার সঙ্গেই। ঝঞ্ঝার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়নমান তুফানের মতো আমরা বহিয়া যাইব। যাহা থাকিবার তাহা থাকিবে, যাহা ভাঙ্গিবার তাহা আমাদের চরণাঘাতে ভাঙ্গিয়া পড়িবেই। দুর্যোগ রাতের নিরন্দ্র অন্ধকার ভেদ করিয়া বিচ্ছুরিত হউক আমাদের প্রাণপ্রদীপ্তি। সকল বাধা-নিষেধের শিখর-দেশে স’পিত আমাদের উদ্ধত বিজয় পতাকা। প্রাণের প্রাচুর্যে আমরা যেন সকল সংকীর্ণতাকে পায়ে দলিয়া চলিয়া যাইতে পারি। ’কাজেই, বার্ধক্য যাদের মস্তিষ্ককে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি, বয়সী-তরুণ-প্রজাপতিরা যাদের এখনও চাঙ্গা ও স্বপ্নের পাখাতুলে এখনও উড়ার ক্ষমতা রাখেন, তাদের উচিত জীবনের এই অমূল্য সম্পদের আশু সদ্ব্যবহার করা।

মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। জীবন থেকে দিন কিন্তু’ চলে যাচ্ছে। আর যে সময় যাচ্ছে, সেটা লক্ষ-কোটি টাকার বা মহামূল্য কোন বস’র বিনিময়েও আর ফিরে আসবে না- সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাবেক বডিবিল্ডার আর্নল্ড শোয়েজনেগর তরুণদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, ‘তুমি আসলে যেটা করতে চাও, শুরু করে দাও। শুরুটাই আসল।’ মানুষের আগ্রহ ও আকাঙ্খা থাকলে সে বহুদূর যেতে পারে এবং সফলতা তার কাছে এসে ধরা দেয়। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে আরেক সফল ব্যক্তি মার্কিন ধনকুবের ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেন, ‘তুমি যদি দরিদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করো এটা তোমার দোষ নয়, তবে তুমি যদি দরিদ্র হয়েই মারা যাও এটা তোমার দোষ।… আমি ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় একবার পরীক্ষায় কয়েক বিষয়ে অকৃতকার্য হই, কিন্তু আমার অন্য বন্ধুরা সব বিষয়ে পাশ করে। তারা এখন আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।

একজন মানুষ তখনই দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যখন যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে সে সফল হয়। চেষ্টা ও সাধনা থাকলে সফলতা আসবেই। আর তারুণ্য হলো জীবনের সেই মোক্ষম সময়, যে সময় পুরোপুরি ঈশ্ব্বরের আর্শীবাদপুষ্ট। এ বয়সে সে যেখানে হাত দিবে সেখানেই সোনা ফলবে, সেখানেই গড়ে উঠবে নতুন সভ্যতা, নতুন ইতিহাস। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, মহাবীর আলেকজান্দার দি গ্রেট মাত্র ২৩ বছর বয়সে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক নিজ রাজত্বের অংশীভূত করতে পেরেছিলেন। তিনি তার রাজত্ব সুদূর মিসর থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তাই তরুণদের উচিত- প্রথমেই জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং তারপর লক্ষ্যের দিকে যাত্রা করা। এ বিষয়ে মার্কিন মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেছেন, ‘কখনো হাল ছেড়ে দিও না। এখনকার এই দাঁতে দাঁত চেপে করা কষ্টগুলো তোমাকে বিজয়ীর খেতাব দেবে সারাজীবনের জন্য।’ বিশ্বখ্যাত লেখক ও মোটিভেটর ডেল কার্নেগী বলেন, ‘যার মাঝে সীমাহীন উৎসাহ, বুদ্ধি ও একটানা কাজ করার গুণ থাকে, তবে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ’তবে নিঃসন্দেহে এ ক্ষমতা কেবল তারুণ্যের পুঁজি। এটা ঈশ্বরের আর্শীবাদ। তারা এক্ষমতাকে কাজে লাগালেই সহজেই সফলতার দীপ্ত-সূর্যকে স্পর্শ করতে পারে। এ বিষয়ে ভারতীয় পন্ডিত, সাধক ও লেখক স্বামী বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন, ‘একটি লক্ষ্য ঠিক করো। সেই লক্ষ্যকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলো। আর তাকেই চিন্তা করো, স্বপ্ন দেখো। তোমার মস্তিষ্ক, পেশী, রক্তনালী- পুরো শরীরে সেই লক্ষ্যকে ছড়িয়ে দাও, আর বাকি সবকিছু ভুলে যাও। এটাই সাফল্যের পথ।’ বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোও বলেছেন, ‘কাজ শুরু করাই হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।’

আজকের তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যত। জাতির আলোকবর্তিকা। তাই তরুণদের উদ্দেশ্যে বলা- সফলতা অর্জণ করতে হলে তোমরা এখনই প্রস’ত হও। প্রথমেই তোমাদের মনকে সি’র করো, জীবনের লক্ষ্য কী ঠিক করো, তারপর সে পথে এগিয়ে যাও। মনে রাখবে, বাধা আসবে, আর বাধা অতিক্রম করার শক্তিও তোমার আছে। সেটা প্রয়োজন মত আবিস্কার করে নিবে। জানবে, চলার পথে আপদে-বিপদে ঈশ্বর পাশে আছেন, তবে তিনি হাত দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন না। এটাই তার বিশেষত্ব। পাশাপাশি, এখানেই তোমার  ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ! ঈশ্বর চান, তুমি তোমার হাত দিয়েই তোমার বাধা অতিক্রম করো। তা না হলে তুমি কেন তার প্রতিনিধি হবে! শেষ করার আগে মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের কথা দিয়ে শেষ করি। তিনি  বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের সফল বা ব্যর্থ হওয়া তার ক্ষমতার ওপর যতটা না নির্ভর করে, তারচেয়ে বেশি তার দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর নির্ভর করে। যারা সফল হয়, তারা সফল হওয়ার আগে থেকেই সফল মানুষের মত আচরণ করে। এই বিশ্বাসই একদিন সত্যিতে পরিনত হয়। আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি অবশ্যই সফল হবেন, তবে আপনার ব্যবহারেও তা প্রকাশ পাবে। এবং আপনি নিজেই নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গীর সুফল দেখে অবাক হয়ে যাবেন।’

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031