গার্মেন্টকর্মী পারুল। বয়স আনুমানিক ২৪/২৫। আমার বাসার পিছনে একটা টিনসেট বাসায় ভাড়া থাকে। স্বামী ছোটখাটো একটা কাজ করে। ৪ বছরের সংসারে পারুলে ৩ বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে। ওদের সংসারে পারুলের শাশুড়িও থাকে। এই হলো পারুলের সংসার। মাঝেমধ্যে সকালে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে, এই ৮ টার দিকে টিকে হবে পারুলের কয়েকজন সহকর্মী গেটে এসে ডাক দিতেই ও বের হয়ে তাদের সাথে ছোটা শুরু করে।
আমি যে ক’দিন ব্যালকনি থেকে পারুলকে সকালে বের হতে দেখেছি, ততদিন-ই ওর চোখেমুখে এক ব্যস্ততার ছাপ নিয়ে বের হতে দেখেছি। কিন্তু আত্নবিশ্বাসের কমতি দেখিনি তার ভিতরে। ওর ব্যস্ততার সকালে কখনও সে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে যেতো।
সকালে বান্ধবিদের ডাক শুনতে পেয়ে যখন বের হতো, কখনো কখনো ওর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। মায়ের সাথে যাবার বাহানা ধরতো। পারুল যখন গেট থেকে বের হয়ে গলির মাথা ক্রস করতো ঠিক পিছনে একবার ফিরে তাকাতো, দেখতো ওর মেয়েটা গেট পর্যন্ত আসলো কিনা। কখনও এসে গেলেও মুখটা কাপড়ে ঢেকে বাচ্চাটার চোখের আড়াল দ্রুত হয়ে যেতো।
এমন অনেক পারুল এই ব্যস্ত শহরের গার্মেন্টসগুলোতে কাজ করে জীবন চালায়, কেউ কেউ সংসারও। এ শহরের সকাল-সন্ধ্যায় এমন শত শত পারুলদের দলবেধে যাওয়া আসা আমি অনেক দেখেছি। তাদের মধ্যে কাউকে আলাদা করার মতো নয়।
সবার পোশাক এবং চলাফেরার ধরন প্রায় একই। অনেক মেয়েরতো তিন রকমের তিনটি জামা-পাজামা-ওড়না পরা আবার কারো সস্তার বোরকা- হিজাব পরা। দেখতে তেমন একটা আকর্ষণীয় না হলেও তাদের হেঁটে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে আমি আত্নবিশ্বাস দেখতে পেয়েছি। আসলেই তারা সংগ্রামী ও যোদ্ধা। জীবন যুদ্ধে অনেক বড় বোঝা হয়তো তারা বহন করে চলেছেন, তবে তারা অন্যের বোঝা নন। তাদের প্রতিটি স্টেপ বেঁচে থাকার লড়াইয়ের…!
এ সমাজে অনেক শিক্ষিত মেয়ে আছে যাদের অনেককেই চিনি জানি, তারা পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছে। দামী দামী গাড়িতে চড়ছে। আজ লাল গাড়িওয়ালার সাথে কাল নীল গাড়িওয়ালার সাথে পরশু অন্য কোন রংয়ের…! হাতে নামীদামী ফোন। ব্রান্ডের মেকআপ আর পারফিউমে নিজেকে সজ্জিত করে রাখা। সকাল শুরু হতে না হতেই পার্টি। রাতে পার্টি। আবার মধ্য রাতে অচেনা বিছানায়ও পার্টি। এসব কিছু তার মনের চাহিদা মিটাতে করা। কারো কাছ থেকে চেয়ে নেয়া, যাকে বলে ভিক্ষা করা। আর অন্ধকারে নিজেকে আকর্ষণীয় পণ্য বানিয়ে বেচাকেনা করা।
করোনা কালে বেশকিছু ছেলে মেয়ের সম্পর্কে শুনেছি তারা খুব কষ্টে দিন পার করছে। কিন্তু কয়েকমাস আগেও তাদের ঠাট বাট দেখে বোঝার কোন উপায় ছিলো না যে, তাদের জন্য বর্তমান দিনগুলো অপেক্ষা করছে। অনেক মেয়েকে তো বিমান ছাড়া চড়তেই দেখিনি। চলাফেরা শিল্পপতিদের কাতারে। তাদের এতো বার বিমানে চড়ার ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করতে দেখেছি। বিশ্বাস করুন ততবার আমি বাসেও চড়িনি। আসলে কখন-ই তারা স্বনির্ভর ছিলো না। পরনির্ভর হয়ে শো অফ করে বেড়িয়েছে। যার পরিনামে কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা অর্থের ঝুঁকিতে পড়েছে।
আবার অনেক শিক্ষিত মেয়ের সম্পর্কে জানি― তারা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে, কেউ আবার গৎবাঁধা কোন চাকরিতে না ঢুকে নিজেই আরো অনেকের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পাশাপাশি অনেকের রুটি-রুজির উছিলা হয়েছে। আবার বেশকিছু মেয়েকে অন লাইন কেন্দ্রীক ব্যবসা করে সফল হতেও দেখেছি। তাদের হয়তো এ ব্যবসা না করলেও চলে, বাবা বা স্বামীর যা আছে তা দিয়ে অনেক সুন্দর জীবন পার করা সম্ভব। আসলে এটা যতটা না টাকার জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
আপনার অনেক অনেক পড়াশুনা করা দুর্দান্ত রেজাল্টওয়ালা সার্টিফিকেট অর্জন করে ড্রয়ারে বন্দি রেখে আপনাকে কীভাবে মানসিক শান্তি দেয়? যে শিক্ষা আপনাকে স্বনির্ভর হতে শেখায় না। যোগ্যতা সবারই কিছু না কিছু থাকে। সেসব কাজে লাগাতে জানতে হয়।
আপনি যতদূর ইচ্ছা পড়াশোনা করুন।সেইসঙ্গে নিজের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানও ধরে রাখতে শিখুন। নিরক্ষরতা যেমন অভিশাপ, পরনির্ভরশীলতা আরও বড় অভিশাপ। অন্যের পকেটে নিজের টাকা আছে তাই ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে অন্তত নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিন। নিজের রোজগারের টাকা নিজ পকেটে আছে তাই ভেবে-ই চলুন। যেমন করে পারুলরা চলছে। নিরক্ষর হয়েও নিজের ও পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে বহন করে চলছে। এবং স্বনির্ভর হয়ে সমাজে বুক উঁচু করে বেঁচে আছে। এমন হাজারো পারুলদের প্রতিটি পদক্ষেপে বেঁচে থাকার আনন্দ পাই। স্যালুট পারুল।
লেখকঃ মিলন মাহমুদ রবি, গণমাধ্যম কর্মী
Add Comment