হ্যালোডেস্ক
বিউটি বোর্ডং বাংলাদেশের ঢাকার পুরনো অংশের বাংলা বাজারে ১নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত একটি দোতলা পুরাতন বাড়ি যার সাথে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত এবং বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার একটি কেন্দ্র বা ইতিহাসের ভিত্তিভূমি বলে মনে করা হয়।
ইতিহাস
ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংকে বাংলাসাহিত্য, কবিতা কিংবা সিনেমার আঁতুড়ঘর বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। বিউটি বোর্ডিং ছিল পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত ঠিকানা। মাঝে ভাটা পরে ১৯৭১ সালের মার্চে। পাকহানাদার বাহিনী জেনে যায় বাঙালির এই সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের মিলনমেলার কথা। ২৮ মার্চ এখানেই শহীদ হন বিউটি বোর্ডিংয়ের কর্ণধার প্রহ্লাদ সাহাসহ আরও ১৭ জন।
বর্তমান বিউটি বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপক বিজয় সাহা বলেন, ১৯৭২ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে ফিরে আসেন প্রহ্লাদ সাহার সহধর্মিণী প্রতিভা সাহা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিউটি বোর্ডিংকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পদক্ষেপ নেন কবি বেলাল চৌধুরী ও শহীদ কাদরী। এরপর একে একে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন অনেকে।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রেরণায় আবারো নতুন উদ্যমে শুরু হয় বোর্ডিংয়ের কার্যক্রম। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তারক সাহা বিউটি বোর্ডিংয়ের হাল ধরেন। বড় ভাই সমর সাহাও খোঁজ নিতে ভুলতেন না। কেননা এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাদের পিতার ছায়া। কিন্তু একে একে নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ।
শ্যামল-সবুজে ঘেরা বিউটি বোর্ডিংয়ের সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকতেই স্বাগত জানাল এক টুকরো বাগান। ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। বাগান থেকে চোখ ফেরাতেই দেখা মিলল একটি পুরোনো বাড়ি- হলুদ রঙ, অনেকটা এল আকৃতির দোতলা। প্রখর রোদের মধ্যেও একটা শীতল ভাব— গাছপালা আর বাগানের জন্য। ডান পাশে অফিস। এর সামনে চোখে পড়ল একটি ডিজিটাল ব্যানার। শোকের কালো রঙের ওপর লেখা : ‘যে বন্ধুদের হারিয়েছি।’ সে তালিকায় তারক সাহাও যোগ হলেন গতকাল থেকে। তিনি রেখে গেছেন সহধর্মিণীসহ এক মেয়েকে।
বিউটি বোর্ডিংয়ে সমবেত হতেন যারা
বিউটি বোর্ডিং চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল। সমমনা লোকদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছিল এই ভবন। বিউটি বোর্ডং এর জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এখানে যারা আড্ডার আসরে আসতেন এদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, গোলাম মুস্তাফা, খালেদ চৌধুরী, সমর দাস, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুর হক, জুয়েল আইচ প্রমুখ। এছাড়া কবি বেলাল চৌধুরী তাঁর ‘সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে’ বইয়ে বেশ কয়েক জায়গায় বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে লিখেছেন।
তারক সাহার বড় ভাই সমর সাহা জানালেন, বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীরচন্দ্র দাসের। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে ওই দালানে গড়ে উঠেছিল ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার কার্যালয়, সঙ্গে ছিল ছাপাখানা। সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়। এ সূত্রেই ভবন মুখর হয়ে ওঠে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের পদচারণায়। সোনার বাংলা পত্রিকাতেই ছাপা হয় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা। দেশ ভাগের সময় পত্রিকা কার্যালয়টি নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। ১৯৪৭-পরবর্তী দুই বছর খালি পড়েছিল ভবনটি। ১৯৪৯ সালে ভাড়া নেন মুন্সিগঞ্জের দুই ভাই নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদচন্দ্র সাহা। যাত্রাটা হলো খুবই সাদামাটা। ব্যবসা জমে উঠলে তৎকালীন জমিদার সুধীরচন্দ্র দাসের কাছ থেকে ১১ কাঠা জমি নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন এই বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ। সমর সাহা বলেন, ‘জায়গাটি ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। সমমনা মানুষদের নির্জলা আড্ডা চলত দিনরাত। পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তুরের দশক ছিল বিউটি বোর্ডিং-এর যৌবনকাল। এ সময় আড্ডা দিতে আসতেন সে সময়ের প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা।
কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে এবং সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজার। এই বিউটি বোর্ডিং-এ দুজনের পরিচয় হয়েছিল। বিউটি বোর্ডিং লাগোয়া একটি পুরনো দালানের দোতলায় থাকতেন কবি শহীদ কাদরী। বিকেলে বোর্ডিং-এর সবুজ চত্বরে এককাপ চা কয়েকজন ভাগ করে খেতে খেতে তখনকার শিল্পী সাহিত্যিকরা মেতে উঠতেন জমজমাট আড্ডায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীমউদদীন। এসেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখান থেকেই ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘কবি কণ্ঠ’। আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘স্বদেশ’সহ আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী। কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখি করার জন্য একটা নির্দিষ্ট টেবিল এবং চেয়ার ছিল বিউটি বোর্ডিং-এ। এখানে বসেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান। সমর দাস অনেক বিখ্যাত গানের কথায় সুর বসিয়েছেন এখানে আড্ডা দেয়ার ফাঁকে।
এরপর সময়ের বিবর্তনে বিউটি বোর্ডিং আগের মতো জমে ওঠেনি। বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐহিত্য অম্লান রাখতে কম চেষ্টা চলছে এখনও। বিউটি বোর্ডিংয়ে এখন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আড্ডা বা পদচারণা নেই। তবে আগের মতো আড্ডা কিংবা লেখকেরা আসেন না, কারণ পুরান ঢাকার যানজট। তাছাড়া লেখকেরা প্রায় সবাই নতুন ঢাকায় বসবাস করেন। যারা আশপাশে থাকেন তারা আসেন।
বিউটি বোর্ডিং নিয়ে সমর সাহার ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ‘একাত্তরে বাবাসহ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি ম্যুরাল, একটি পাঠাগার এবং বিউটিয়ানদের একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা। যেন তাদের কিছু স্মৃতি ধরে রাখতে পারি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।
আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন।
Add Comment