সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
– বন্দ্যোপাধ্যায় ঝুমা
সেই কোপাই সেতু। রেলগাড়িটা পেরিয়ে গেল নিমেষে। বালিতে জ্বলে উঠেছে চিতা। কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে – “ভুল বললে, উনি সিপিএম না, কমিউনিস্ট”। টিনের ছাউনি দেওয়া আলকাতরা লেপা দোতলা মাটির দেওয়াল ঘিরে ফিরে আসা। অদূরে বল্লভপুর। ঠিক যেন আমারই গ্রামের মত। মাঠের পর মাঠ সবুজ কার্পেট। দূরে ধানের জমি পাহারা দিচ্ছে কাকতাড়ুয়া। পাখির হাত থেকে বাঁচাচ্ছে চাষীকে কিন্তু ন্যায্য মূল্য ?.. খুব চেনা দৃশ্য। চেনা প্রশ্ন? যেন স্পেস থিয়েটারে চড়ে ফিরে যাচ্ছি ‘দেশের বাড়িতে’। সত্যি তো! কতবার বদলে গেল বাড়ি। পাড়া-প্রতিবেশীর জিজ্ঞাসা, ‘কবে এলি রে, বাড়ির সকলে ভালো তো’? কোন বাড়ি ? যদি দিন কয়েক বেশি থাকা হয়, ‘হ্যাঁ রে সব কিছু ঠিকঠাক তো’। মনিপিসি সেবার বাচ্চা হতে সেই যে এল আর গেল না। ধীরে ধীরে পাগলী হয়ে গেল। এখন লোনাধরা দেওয়ালের রোদ আগলায়। অধুনা ভিনদেশি মৌ’দির সঙ্গে আর বোধহয় দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ওই একই রকম। জাস্ট একটু অদল বদল । দাদা সিনেমার হিরো, সুপার হিরো, কিংবা ‘নায়ক’ কিনা সেটা মানিকবাবু থাকলে বলতে পারতেন। তবে সুরভিত এন্টিসেপটিক – ‘পোয়েনজিৎ থেকে প্রসেনজিৎ। সুখদুঃখ সানগ্লাসে ঢেকে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে এল। হোটেলের বারান্দায় একঝলক দেখার জন্য কাতারে কাতারে মানুষ। তারে জমিন পর। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই চক্কত্তি কাকা জিজ্ঞেস করলেন, “মাস গেলে কত পাও হে তুমি ? উত্তর এল, ‘কোনো কোনো মাসে একেবারেই শুন্য।’- “ও তাহলে সরকারী কিছু পেলে না”। পাগলি বোনের দরজার শিকল খুলে দিল। সেও অভিনয় করতে চেয়েছিল। খোলা কী গেল ? সব কুঁড়িতো পাপড়ি মেলে না।খুলতে চাইলে ভুলতে হয় নিজের উপার্জিত সত্তাকে। দ্বন্দ্ব বাধল সেখানেই। প্রেম, প্যাশন, খিদে, নেশা, অপমান হজম করে তবেই না ওঠা যায় ক্ষমতার শীর্ষে। আর একবার সেই জেট লেভেলে পৌঁছতে পারলে রক্ষা পাওয়া যায় নিত্যদিনের ছোটখাটো আবহাওয়া পরিবর্তন থেকে। মুখ ঢেকে যায় মেকাপে। একেবারেই অরণ্যদেব। কিন্তু যে ভাইটা রোজ দরজায় শিকল তুলে দেয় সেও বোনকে বাঁচাতে চায়, স্ত্রীকে ভালোবাসতে চায়, পিতাকে শ্রদ্ধা করতে চায় – অন্য ভাবে। পা ছুঁয়ে, সেলুলয়েডে নয়, মাটি থেকে সামান্য উঁচু মঞ্চে যেখানে বাঁচিয়ে রাখা আদর্শের নাম নাটক, ব্যর্থতার অপর নাম সাধনা, আদর্শ বনাম আচার, কাঁচাপাকা দাড়ি, কাঁধে শান্তিনিকেতনের ঝোলা, মুখে দু-এক কলি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তার বসত বাড়ি ‘দেশের বাড়ি’ নয়। তবে দুপক্ষই যন্ত্রনা ভোলে নেশার ছলে। তাহলে সম্পর্কে কে বড়ো – জ্যেষ্ঠ নাকি কনিষ্ঠ? কেউ না। একজন ‘এন ও সি’ দিয়ে মাটি ছেড়ে আকাশ দেখে অপরজন সেই মাটি বিক্রি করে আকাশকে বলে, “আর কত দূরে থাকবি, ঝড়বৃষ্টি মেখেই ধরব তোকে আমি”। চিত্রনাট্য রূপান্তর এভাবেই চলে। যেই একটু আলোর দিশা পাই ওমনি ধেয়ে আসে কালো মেঘ। সত্যজিতের ‘শাখা-প্রশাখা’ ‘নায়ক’ – এই দুই ছায়াছবি কোথায় যেন সমাপতিত হতে চায়। অথবা “রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী”। ধোঁয়াশা। আপনারই কথায়, “বাবার ছেলে যখন চেহারা আদব কায়দায় মিলতো থাকবেই”। কিন্তু যিনি লিখেছিলেন তিনিযে এমনি সমাপ্ত হয়েও অসমাপ্ত, পুরুষ হয়েও স্ত্রী, অপূর্ণতায় সাহিত্য… জ্যেষ্ঠপুত্র দেখতে দেখতে বিশ্বাস করুন ঋতুপর্ণ – শুধু আপনাকেই খুঁজে গেছি। কেবলি মনে হয়েছে, অনেক কিছুই থাকে চিত্রনাট্যের অগোচরে কথাকার ছাড়া তাকে স্পর্শ করা কারোর পক্ষে কোনোভাবেই বোধহয় সম্ভব নয়। সত্যি, অসম্ভব।
Add Comment