সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-অমিত গোস্বামী (কলকাতা)
বঙ্কু আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ছেলেটা ভাল, কিন্তু পিলেতে গোলমাল। ভুলভাল কথা বলার অভ্যেস ওর জন্মগত। ছোটবেলায় একবার বায়োলজি ক্লাসে শিক্ষক প্রাণিজগৎ সম্পর্কে পড়াচ্ছেন। তিনি বঙ্কুকে জিজ্ঞাসা করলেন – বলো তো, হাতি আর ঘোড়ার মধ্যে পার্থক্য কী? বঙ্কু বেমালুম বলে দিল – ঘোড়ার লেজ থাকে পেছনে আর হাতির লেজ থাকে সামনের দিকে! আরেকবার ওর বাবা বললেন – যা তো বঙ্কু, বাজার থেকে দৌড়ে আমার সিগারেট নিয়ে আয়। বঙ্কু বলল – কিসের পিছনে দৌড়ে বাজার যাব? রিক্সা না ট্যাক্সি? বাবা চমকে গিয়ে বললেন – মানে? বঙ্কু নিষ্পাপ মুখে বলল – রিক্সার পিছনে গেলে ৫ টাকা আর ট্যাক্সির পিছনে গেলে ২০ টাকা ফিরে এসে চার্জ করতে হবে না? যেমন তুমি সেকেন্ড ক্লাসে গিয়ে অফিসে এসি ফেয়ার চার্জ করো। বাবা ব্যোমকে বললেন – এসব কথা তোকে কে বলল? বঙ্কু বেমক্কা বলে বসল – কেন? তুমি সেদিন ওই পাড়ার পদীপিসীকে ফোনে বললে যে সেকেন্ড ক্লাসে ট্র্যাভেল করে অফিসে এসি ফেয়ার চার্জ করে তোমাকে সোনার বালা গড়িয়ে দিলাম। বাবা চমকে বললেন – সে কথা তুই কাউকে বলিস নি তো ! বঙ্কু বলল – না, তা বলি নি, তবে মা’কে বলেছি যে রেল কোম্পানির ব্রিটিশ আমলের সোনার লাইন ভাঙ্গা পড়ছে, বাবা এবার তা দিয়ে তোমায় বালা হার গড়িয়ে দেবে, পদীপিসি বাবাকে কত ধরেছিল, বাবা রাজীই হয় নি। বাবা আর কথা না বাড়িয়ে বঙ্কুকে বললেন – থাক, সিগারেটও আর খাব না। এবার ছেড়েই দিতে হবে।
একবার এক পায়ে সাদা আর এক পায়ে নীল জুতা পরে স্কুলে এলো বঙ্কু। ক্লাস টিচার তা দেখে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন – বের হয়ে যা ক্লাস থেকে!
– কেন স্যার?
– না হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে জুতা বদলে আয়!
– তাতে কোনো লাভ হবে না, স্যার। সেখানেও এ রকমই দুটো জুতো রাখা আছে!
পাড়ার গল্পবাজ বুড়ো রনদাদু একদিন চায়ের ঠেকে গল্প দিলেন,
– কী বলবো ভাই! আমাদের কালে আমরা ১০ টাকা পকেটে নিয়ে বাজারে যেতাম। তারপর ঝাঁকাভর্তি মাছ-মাংস-তরকারি-মসলা তো আনতামই, সঙ্গে থাকতো হরেকরকম ফল…
বঙ্কু বেমক্কা বলে বসল,
– তা কিন্তু এখন আর তা সম্ভব না দাদু। সব দোকানেই সিসি ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছে…
এহেন বঙ্কু পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পেয়ে বেশ এলেমদার হয়ে উঠল। কিন্তু তার অবান্তর কথা বলার অভ্যাস গেল না। একদিন বঙ্কুর এক অধস্তন কর্মচারী এসে বঙ্কুর ঘরে ঢুকে বলল,
– স্যার, একটা কথা ছিল।
– বলে ফেলুন।
– স্যার, এবার আমার বেতনটা একটু বাড়িয়ে দিলে ভালো হতো।
– কেন?
– গত সপ্তাহে বিয়ে করেছি। তাই আগের বেতনে দুজনের চলাটা বেশ কষ্ট হবে, স্যার।
– শুনুন, অফিসের বাইরের কোনো দুর্ঘটনার জন্য অফিস কোনোভাবেই দায়ী নয়। আর তার জন্য জরিমানা দিতেও অফিস রাজি নয়।
সম্ভবত সেই অধস্তনকর্মীর অভিশাপে বঙ্কু কিছুদিন পরে প্রেমে পড়ল। সে নাকি দারোগার মেয়ে। দারোগা নাকি মেয়ে ও বঙ্কুর আশনাই জেনে ফেলেছেন। মেয়েটি বঙ্কু সম্পর্কে কোন তথ্যই দারোগাকে দেয় নি। দারোগা নাকি সব জেরা করে জেনে নেবেন। বঙ্কু বেশ টেনশনে। ডাক পড়ল আমাদের দুই বন্ধুর। দারোগা যখন বঙ্কুর ইন্টারভিউ নেবে তখন আমরা যেন আশেপাশে থাকি। সেই মত একদিন হাজির হলাম ‘অবসর’ রেস্তোঁরাতে। সেখানেই দারোগার আসার কথা। এক টেবিলে বঙ্কু বসেছে। পাশের টেবিলে আমরা। কিছুক্ষণ পরে এক তরুণী আর তার সঙ্গে আরেক ভদ্রমহিলা এসে বঙ্কুর টেবিলে বসলেন। তার মানে দারোগা আসেন নি। ভদ্রমহিলা চোখের সানগ্লাসটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন,
– আমি ঐশীর মা। আমি কি কয়েকটা কথা তোমার থেকে জানতে পারি?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়য়ই।
– তুমি কী জাতি?
– হোমো স্যাপিয়েন্স, মনুষ্য জাতি।
– আঃ! কোন বর্ণ?
– দেখছেন তো, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
– রাশি, গণ?
– বিরাশি পার্সেন্ট বি এস সিতে, আর আমি সাধারণ জনগণ।
– ওফ, আচ্ছা, তোমার বাড়ি কোথায়?
– বাড়ি নাই।
– মানে? থাকো কোথায় ?
– বাসায়। ভাড়া ।
– না, মানে তোমরা কোথাকার লোক? এপারের না ওপারের?
– বাঙাল।
– এহ। ওপারের ?
– আমি পাত্র। পুং লিঙ্গ। তাই বাঙাল।
– তোমার কামাই কী?
– আমি কি পুলিশ যে উপরি কামাই থাকবে। আমার শুধু মাইনে।
– আচ্ছা, তুমি আমার মেয়েকে কীভাবে চিনলে?
– মেয়েমানুষকে কে কবে চিনতে পেরেছে, দিদি।
– দিদি? আচ্ছা, তুমি কি আমার মেয়েকে ভালবাস না?
– ভালবাসি না এমন তো বলছি না, তবে…
– তবে কি?
– এই ভালবাসায় এক পোয়া দুধে তিনপোয়া জল নাকি উল্টোটা বুঝি নি।
– সেকী ! আমার মেয়ের সাথে ঘুরলে বেড়ালে এখন বলছ…
– কি করব? দারোগার মেয়ে। কতটা ভেজাল এখনও বুঝে উঠতে পারি নি।
– তোমাকে আমি জেলে দিতে পারি, জানো?
– যদিও এখন সুলভ নয়, তবে জেলখানায় যাতে মাস দুই ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণ হয় সে ব্যবস্থা যদি আপনি করেন তাহলে গরীব ব্রাহ্মণ উদ্ধার পায়।
হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে ভদ্রমহিলাকে বললেন,
– গিন্নি, ধরে ফেলেছি। ডায়ালগটা দিল ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী’ থেকে। তাই ছেলের নাম হওয়া উচিৎ ছিল কমলাকান্ত চক্রবর্তী, কিন্তু ডাক নাম যেহেতু বঙ্কু, এর নাম হতেই হবে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কি তাই তো?
– ঠিক তাই। আর আপনি বাঙলার শিক্ষক এবং মাসীমা দারোগা। ঐশী আমাকে বলেছিল যে মা বাবা দারোগা ও বাঙলার টিচার। কিন্তু কে দারোগা আর কে বাংলার শিক্ষক কখনো বলে নি। শুধু বলেছিল, আন্দাজে নয় প্রমাণসহ বলতে হবে মা বাবার পরিচয়। কে কী!
– আর আমাদের তোমার নাম ধাম কিছুই বলে নি। বলেছিল বার করে নাও। কি ঐশী আমরা পাস তো?
– ঠিক। দুজনেই পাস।
Add Comment