হ্যালোডেস্ক
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ষষ্ঠবারের মতো শ্রেষ্ঠ গীতিকবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মনোনয়ন পেলেন সাংবাদিক-সুরকার কবির বকুল। দেশ তো বটেই পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গেও কাজের দারুণ সব অভিজ্ঞতা রয়েছে গীতিকবি সংঘের অন্যতম এই সাধারণ সম্পাদকের।
তবে এবারের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দ তার কাছে অনেকটাই ম্লান। কারণ, একই দিনে (১৫ ফেব্রুয়ারি) খবর পেলেন বাংলা গানের গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর। কবির বকুলের ভাষায়, ‘গতকাল (১৫ ফেব্রুয়ারি) দিনটা সুন্দর হয়ে গিয়েছিল শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে ষষ্ঠবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের খবরে। চারদিক থেকে শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা পাচ্ছিলাম। তবে রাতে আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম সেরা শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবরে বিষণ্ণ হয়ে যায় মন। মনে পড়লো, ৮-৯ বছর আগে কলকাতায় একটি হোটেলের বলরুমে চ্যানেল আই এই বরেণ্য শিল্পীকে চ্যানেল মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। আমি এবং আমার স্ত্রী শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নীর সৌভাগ্য হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার, এই গুণী শিল্পীকে খুব কাছ থেকে দেখার।’ যোগ করেন, ‘পদ্মশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অধ্যায় শেষ হলেও তিনি সন্ধ্যা প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন সংগীতের আকাশ তলে।’
এমন বিষণ্ণ প্রত্যাশা নিয়ে মঙ্গলবার দিন শেষ করলেও রেশটা আরও গভীর হয়ে ধরা দেয় পরদিন বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে। কবির বকুল তখন রমনা পার্কে হাঁটছিলেন। তখনই খবরটা এলো তার মুঠোফোনে। কিংবদন্তি সুরকার ও শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী আর নেই! বাড়ি ফিরে খুঁজে বের করলেন এই কিংবদন্তির সঙ্গে পুরনো কিছু ছবি। সেই রেশ ধরে ধরা দিলো কিছু স্মৃতি। যে স্মৃতিতে রয়েছে, অন্যের সুরে গাওয়া বাপ্পি লাহিড়ীর প্রথম কোনও গান সৃষ্টির ঘটনা।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কবির বকুল জানান, ‘কৈশোর বয়স থেকেই আমি বাপ্পিদার গানের ভীষণ ভক্ত। ওই বয়সে একটু একটু গাইতাম। আর প্রিয় গানের তালিকায় বাপ্পিদার সুর করা ও গাওয়া– মঙ্গল দীপ জ্বেলে, আর ফেরানো যায় না কেন, সোনার আখরে লেখা, মনে পড়ে তুমি ছিলে, মুক্তোর ঘুম ঘুম গোলাপি গাল, বালিতে তোমার নাম লিখে দেবো, বলছি তোমার কানে কানে, শেষ ট্রামে দুজনাতে, চিরদিনই তুমি যে আমার– এরকম অসংখ্য গান।’
বলতে থাকেন, ‘‘প্রিয় এই মানুষটির প্রথম দেখা পাই ১৯৯৫ সালে। তিনি সেই বছর গান গাইতে আসেন একটি অনুষ্ঠানে। বলিউড অভিনেত্রী জয়াপ্রদা ও শিল্পী কুমার শানুও ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আমি তখন ভোরের কাগজ পত্রিকায় কাজ করি। আমি বাপ্পিদার একটি সাক্ষাৎকার নেই ওই সময়। এরপর ২০০৮ সালে রিয়েলিটি শো ‘সুর দরিয়া এপার বাংলা ওপার বাংলা’-এর দুটি পর্বে অতিথি হিসেবে তাঁর পাশে বসার সৌভাগ্য হয়। দুদিন বাপ্পিদার কাছাকাছি থেকে তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা দুটোই পেলাম। তাঁর সঙ্গে একটা সখ্য হয়ে গেলো। তিনি আমার লেখা গান চাইলেন। সেই গান তাঁকে দেবার সৌভাগ্যও হলো। তবে তা একটু অন্যভাবে।’’
কেমন করে কবির বকুলের কথায় শওকত আলী ইমনের সুরে গাইলেন বাপ্পি লাহিড়ী, সেই অদ্ভুত গল্পটি এবার শোনা যাক। কবির বকুলের জবানিতে, ‘২০১০-এ তিনি আবার ঢাকায় এলেন। আমি তখন সোহানুর রহমান সোহান ভাইয়ের ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ ছবির গান লিখছি। আর ছবির সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন। আমরা ছবির সিকোয়েন্স অনুযায়ী একটি চটুল রোমান্টিক ডুয়েট গান করলাম। এখন গানটি কে গাইবেন? আমি হঠাৎ বললাম, এটা বাপ্পি লাহিড়ীকে দিয়ে গাওয়ালে কেমন হয়। সোহান ভাই আর ইমন দুজনেই বললেন, কী করে সম্ভব? প্রথমত তিনি মুম্বাই থাকেন, দ্বিতীয়ত তিনি নিজের সুর করা গান ছাড়া অন্য সুরকারের গান কখনও গাননি। আমি দুজনকে আশ্বস্ত করলাম, বললাম বাপ্পিদা এখন ঢাকায়। আমার সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়েছে। তিনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন। একবার চেষ্টা করি। সোহান ভাই বললেন, দেখ, রাজি হবেন বলে মনে হয় না। ইমন ভীষণ এক্সাইটেড।’সেই রাতেই কবির বকুল ছুটে যান চ্যানেল আইয়ের ছাদে। যেখানে বাপ্পি লাহিড়ী গাইছিলেন ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ গানটি। তাঁর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মঞ্চে ছিলেন বিউটি দাস।
‘গান শেষে তিনি হোটেলে ফিরে যাবার পথে সামনে গিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছ কবির বকুল। কুশল বিনিময়ের পর বললাম দাদা, একটা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি। তিনি বললেন, হোটেলে আসো। সেখানে কথা বলবো। পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসেই প্রস্তাবটা দিয়ে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে বললাম, দাদা, আপনি তো নিজের সুর করা গান গেয়েছেন। অন্যের সুরে তো গাননি। বাপ্পিদা বললেন, না। কেন বলো তো। বললাম, আমার একটা অনুরোধ, আমাদের বাংলাদেশের একটি ছবির জন্য একটা গান আমি লিখেছি, গানটি সুর করেছে আমার বন্ধু শওকত আলী ইমন। এই সময়ের সবচাইতে টেলেন্টেড সুরকার। আপনি যদি এই গানটি গাইতেন? মানা করতে পারবেন না দাদা’, যোগ করলেন কবির বকুল।
তার এমন প্রস্তাবে হেসে ফেলেন বাপ্পি লাহিড়ী। জানান, গান পছন্দ হলে গাইবেন। এরপরের ঘটনা এভাবে বলেন কবির বকুল, ‘আমি সেখান থেকেই ইমনকে মুঠোফোনে জানালাম, একটা সিডিতে গানের গাইড ভয়েসটা দিতে। আমি আসছি, ওটা রাতেই বাপ্পিদাকে শোনার জন্য দিতে হবে। ইমনের কাছ থেকে সিডি এনে বাপ্পিদার রুমে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলাম রাতেই। পরদিন সকালে ঠিক ১০টায় কল করলাম। ও-প্রান্ত থেকে বাপ্পি দা বললেন- বকুল, গানটা ভালো হয়েছে, মনে হলো আমার জন্যই করা। আমি গাইবো। কিন্তু সম্মানী কি দেবে? তারপরের কথোপকথনটুকু না-ই বলি। শুধু বলি, তিনি বললেন যে সম্মানী দেবে বলেছ, এই সম্মানীতে আমি গান করি না, তবে তোমার জন্য গাইবো। ঠিক তিনটায় আমাকে এসে নিয়ে যেও।’
এরপর কথামতো ঠিক তিনটায় কবির বকুল নিজেই ড্রাইভ করে হোটেল থেকে রিপন খানের স্টুডিওতে নিয়ে যান বাপ্পি লাহিড়ীকে। এরপর, ‘ইমনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। দাদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই তিনি বললেন, ইমন তুমি খুব ভালো সুর করেছ। ইমন বাপ্পিদা হারমোনিয়ামে গানটা তুলে দিলেন। বাপ্পিদা দুবার দেখে নিয়েই সিঙ্গার বুথে ঢুকে গেলেন। ১৫ মিনিটেই গেয়ে দিলেন গানটি। চটুল গান, তাই কিছু নখরামিও করলেন গানের কোথাও কোথাও। যাই হোক, দ্বৈত এ গানটির নারী কণ্ঠ নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। ওই সময় ঢাকায় এসেছিলেন মিতালি মুখার্জি। তিনি গেয়ে দেন।’ গানটি ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ চলচ্চিত্রে রিয়াজ-পূর্ণিমার ঠোঁটে শোভা পেয়েছে।
কবির বকুল শেষটা করেন এভাবে, ‘বাপ্পি লাহিড়ী চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু রেখে গেছেন আমার গানে তাঁর ভালোবাসা। চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না/ কাভি আল বিদা না ক্যাহেনা- ওপারে ভালো থাকবেন কিংবদন্তি।’
গত বছরের এপ্রিলে বাপ্পি লাহিড়ীর করোনা শনাক্ত হয়। তখন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছু দিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এক মাস আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় মুম্বাইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে যান। মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে ‘অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় (ওএসএ)’ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
প্রায় পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে হিন্দি, বাংলা, তেলুগু, তামিল ও গুজরাটি ভাষায় গান তৈরি করেছেন বাপ্পি লাহিড়ী। আশি ও নব্বই দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ডিস্কো মিউজিককে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয় তাঁকে।
Add Comment