হ্যালোডেস্ক
সংবাদপত্রের ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন রোম সম্রাটদের ঘোষণাপত্রসমূহকে সংবাদপত্রের আদি উৎস বলে মনে করা হয়। জনগণের পড়ার সুবিধার্থে রোম সম্রাটদের ঘোষণাপত্রগুলোকে পাথরে খোদাই করে রোম নগরীর বিভিন্ন স্থানে টাঙিয়ে দেওয়া হতো, এটাকে বলা হতো ‘অ্যাক্টা দিউরমা’। তবে বর্তমানে আমরা সংবাদপত্র বলতে যা বুঝি তার সূত্রপাত ঘটে চীনে, ৮ম শতাব্দীর দিকে চীনের রাজদরবার থেকে ‘কাইয়ুয়ান ঝা বাও’ বা ‘আদালতের বার্তা’ নামে একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। তারপর থেকে সময় গড়িয়েছে অনেক, এসেছে আরও বহু সংবাদপত্র, পরিবর্তন হয়েছে সংবাদপত্রের ধরন ও প্রকাশনা পদ্ধতির, কম্পিউটার আবিষ্কারের পরে দৈনিক সংবাদপত্র পেয়েছে নতুন মাত্রা। ইন্টারনেটের সুবিধায় এসেছে অনলাইন পত্রিকা। এতসব পরিবর্তন যখন সারা বিশ্বে ঘটে যাচ্ছে, তখনও ভারতে একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে হাতে লিখে! সেই ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটির নাম ‘দি মুসলমান’। চেন্নাই থেকে প্রকাশিত এই সংবাদপত্রটিকে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা দৈনিক সংবাদপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘দি মুসলমান’কে এই ঐতিহাসিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
‘দি মুসলমান’ ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন উর্দু সংবাদপত্রও বটে। সাধারণত দৈনিক পত্রিকাগুলো সকালে প্রকাশিত হলেও ‘দি মুসলমান’ প্রকাশিত হয় সন্ধ্যায়। এর কারণ, পত্রিকাটি হাতে লিখে প্রস্তুত করতে করতেই দুপুর হয়ে যায়, তারপরে প্রেসে ছেপে পাঠকদের হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়ে যায় সন্ধ্যা। শুধুমাত্র হাতে লেখাই এই পত্রিকাটির বিশেষত্ব নয়; পত্রিকাটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি পেশাদার ক্যালিগ্রাফারদের ক্যালিগ্রাফি দ্বারা সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। এটি পত্রিকাটির আকর্ষণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পত্রিকাটির বর্তমান বয়স ৯১ বছর।
পত্রিকাটির সম্পাদক সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এক যুবক তিনি। তার ভিজিটিং কার্ডে তার অর্জিত ১৩টি শিক্ষাগত ডিগ্রির কথা উল্লেখ রয়েছে। সম্পাদক আরিফুল্লাহর বর্তমান বয়স ৩০ বছর। প্রায় ১০ বছর যাবত তিনি এই পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালে। সম্পাদক সাইয়েদ আরিফুল্লাহর দাদা সাইয়েদ আজাতুল্লাহ এই পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন চেন্নাইতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো না, অন্য সাধারণ সংবাদপত্রগুলো মুসলমানদের কথা তুলে ধরত না। এমন প্রেক্ষিতে আজাতুল্লাহ চিন্তা করলেন, স্থানীয় মুসলমানদের কথা তুলে ধরার জন্য একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। সেই অনুভূতি থেকেই তিনি ‘দি মুসলমান’ পত্রিকাটির গোড়াপত্তন করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত পত্রিকাটিতে বংশ পরম্পরায় তিনজন সম্পাদক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রথম সম্পাদক ছিলেন পত্রিকাটির স্বপ্নদ্রষ্টা সাইয়েদ আজাতুল্লাহ। তার মৃত্যুর পরে পত্রিকাটির হাল ধরেন তার পুত্র সাইয়েদ ফাজলুল্লাহ। ২০০৮ সালে ফাজলুল্লাহ মারা গেলে পত্রিকাটির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার সন্তান ও বর্তমান সম্পাদক সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। সাইয়েদ আরিফুল্লাহর আশাবাদ, তার পরে তার সন্তান এই পত্রিকাটির দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবেন, যদিও তার সন্তানের বর্তমান বয়স মাত্র ৫ বছর।
‘দি মুসলমান’ পত্রিকার অফিস চেন্নাইয়ের ট্রিপলিকেন হাই রোডে। পত্রিকাটির উপরে তৈরিকৃত এক ডকুমেন্টারিতে দেখা যায়, চেন্নাইয়ের বিখ্যাত ওয়ালাজাহ মসজিদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটি ছোট্ট গলির মধ্যে পত্রিকাটির অফিস অবস্থিত। অফিসের মধ্যে রয়েছে দুটি স্বল্প প্রশস্ত রুম। এর একটিতে রয়েছে প্রেস এবং অন্যটিতে রয়েছে অতিথিদের জন্য অভ্যর্থনা কক্ষ। অফিসের আয়তন মাত্র ৮০০ বর্গ ফুট। অফিসের ব্যবস্থাপনাও বেশ সাদামাটা। অফিসে রয়েছে দুটি ওয়াল ফ্যান, তিনটি বাল্ব ও একটি টিউব লাইট।
অফিসের বাইরে টাঙানো রয়েছে পত্রিকাটির একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটিতে ইংরেজি ও উর্দু ভাষাসহ তিনটি ভাষায় পত্রিকাটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি- রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ফোন নম্বর, পত্রিকার নাম, অফিসের ঠিকানা ও প্রতিষ্ঠাকাল লেখা রয়েছে। মোট চার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় ‘দি মুসলমান’ পত্রিকাটি। হাতে লেখা এই পত্রিকাটির বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২২,০০০ এর অধিক। চেন্নাই ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এর গ্রাহক। অনেকে শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত কারণেই পত্রিকাটির গ্রাহক হয়ে আছেন। দূরের পাঠকদের জন্য রয়েছে ডাকের মাধ্যমে পত্রিকা পৌঁছানোর পদ্ধতি। গ্রাহকদের বেশিরভাগই মুসলিম, তবে উর্দু ভাষা জানেন এমন কিছু হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী গ্রাহকও রয়েছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পত্রিকাটির দাম মাত্র ৭৫ পয়সা। মূলত এটি একটি অলাভজনক সংবাদপত্র। এক সাক্ষাৎকারে পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক সাইয়েদ আরিফুল্লাহ জানান, “এটা ভারতের সবচেয়ে কম দামের পত্রিকা”। তিনি বলেন, “দি মুসলমান থেকে আমাদের কোনো আয় হয় না, আমাদের আয় হয় প্রেস থেকে, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমরা এই পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছি।”
পত্রিকাটির প্রায় সকল সংবাদ ও লেখা বাছাই করেন সম্পাদক আরিফুল্লাহ নিজেই। চেন্নাই ছাড়াও কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই, নয়া দিল্লিসহ সমগ্র ভারত জুড়েই ‘দি মুসলমান’ পত্রিকাটির সংবাদদাতা রয়েছে। তবে এর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রকাশিত কোনো সংবাদেই উক্ত সংবাদের সংবাদদাতার নাম উল্লেখ করা হয় না। এ বিষয়ে সম্পাদক আরিফুল্লাহ বলেন, “দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের সংবাদদাতা রয়েছে, কিন্তু ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার মতো আমরাও পত্রিকায় আমাদের কোনো সংবাদদাতার নাম উল্লেখ করি না।”
সংবাদপত্রটি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে একটি নিজস্ব কর্মপদ্ধতি। প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে দুজন অনুবাদক পত্রিকাটির অফিসে আসেন। তারা সারা দেশ থেকে সংবাদদাতাদের পাঠানো সংবাদ থেকে প্রকাশের জন্য বাছাইকৃত সংবাদগুলোকে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। দুই ঘণ্টা পর তিনজন ক্যালিগ্রাফার পত্রিকাটির ক্যালিগ্রাফি আঁকা শুরু করেন। এ ক্যালিগ্রাফারদের ‘কাতিব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তারা বিশেষ ক্যালিগ্রাফিক কলম দ্বারা প্রত্যেকটি সংবাদ পত্রিকার কাগজে লিপিবদ্ধ করেন।
যখন ক্যালিগ্রাফি ও তাদের লেখার কাজ শেষ হয় তখন পত্রিকাটিতে দৈনিক প্রাপ্ত বিজ্ঞাপনগুলো সংযুক্ত করা হয়। কিছু সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যদি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ফাইল প্রদান করে তাহলে তা-ও ক্যালিগ্রাফাররা হাতে এঁকে পত্রিকায় সংযুক্ত করে দেন। সকল প্রস্তুতি শেষে পত্রিকাটি প্রেসের মাধ্যমে ছাপার জন্য নেগেটিভে স্থাপন করা হয়। মোটামুটি দুপুর ১টার দিকে পত্রিকাটি ছাপানো শুরু হয় এবং সন্ধ্যার দিকে সকল গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যায়।
পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ, দ্বিতীয় পাতায় সম্পাদকীয়, তৃতীয় পাতায় স্থানীয় এবং চতুর্থ পাতায় খেলাধুলার সংবাদ। তবে ‘দি মুসলমান’ এর সোমবারের সংখ্যাটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী হয়ে থাকে। এ দিনে কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কিত প্রবন্ধ বেশি প্রকাশ করা হয়।
পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চিন্নাস্বামী বালাসুব্রানিয়াম। সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উসমান গনি। পত্রিকার কাতিব সংখ্যা তিনজন। প্রধান কাতিবের নাম হচ্ছে রাহমান হোসেইনি। অন্য দুই কাতিব শাবানা বেগম এবং খুরশিদ বেগম।
পত্রিকাটিতে সাধারণত ‘ব্রেকিং নিউজ’ প্রকাশ করা হয় না। পত্রিকার সম্পাদক জানান, “আমরা সাধারণত কোনো ব্রেকিং নিউজ প্রকাশ করি না। পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা প্রকাশ দুঃসাধ্য, তাই আমরা এটা বাদ দিয়ে দিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের সমাজের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে থাকি। নিশ্চয়ই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসলাম ও ইসলাম সংক্রান্ত শিক্ষাকে তুলে ধরা, তবে এটাই আমাদের সব নয়।” ভারত ভাগের পূর্বে উত্তর ভারত থেকে অনেকগুলো প্রভাবশালী উর্দু পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তখন এসব পত্রিকার ব্যাপক পাঠকও ছিল, বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা উর্দু পত্রিকা পাঠ করত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে উর্দু পত্রিকা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ‘দি মুসলমান’ টিকে থাকায় তা ভারতে আবার উর্দু সংবাদপত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ‘সাহারা’ বা ‘রোজনামা সাহারা’ এবং ‘ইনকিলাব’ এর মতো পত্রিকার পুনরুত্থান ঘটেছে। এসবের পিছনে ‘দি মুসলমান’ পত্রিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘দি মুসলমান’ পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যাও দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সবশেষে সামনে আসে, তাহলে কি ‘দি মুসলমান’ পত্রিকা আজীবন হাতে লিখেই প্রকাশিত হবে? সম্পাদকের সহজ জবাব, হ্যাঁ। কেননা এটিই এই পত্রিকাটির প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। যখন সকল পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ চালু হচ্ছে, তখনও ‘দি মুসলমান’ অনলাইনে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে না। সম্পাদক আরিফুল্লাহর মতে, “এই পত্রিকার বিশেষত্বই হচ্ছে, এটি হাতে লেখা সংবাদপত্র, হাতে লেখা ব্যতিত অন্য কোনো বিকল্প পদক্ষেপ গ্রহণ পত্রিকাটির ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে নষ্ট করে ফেলবে।”
তথ্য: সংগ্রহ
আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন। হ্যালোটুডে’র ইতিহাস বিভাগে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখা পাঠাতে পারেন। হ্যালোটুডে আপনার মনের কথা বলে।
Add Comment