জীবনমঞ্চ

ভিক্ষাবৃত্তি না করে ইনকাম করে খাওয়াই উত্তম

-মিলন মাহমুদ রবি

ঈদের আমেজ এখনও কাটেনি তাই ঢাকা ফাঁকা। এখনও রাজধানীবাসী ঈদের ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসেনি গন্তব্যে। এমন অবস্থায় রাতের আলো-আঁধার মাখা ঢাকার ফাঁকা রাজপথে ঘুরতে কার না মন চায়! ব্যঁস্ত শহরকে একটু আলাদা রুপে পেয়ে আমারও আনন্দ ছিলো সবার মতো। তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমাতে মন চাইলো রাজধানীর হাতিরঝিলে। সবাই এদিক ওদিক ঘুরে ছুটলাম হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে। যেয়ে দেখলাম কিছুটা ভিন্নতা সব দিনের চেয়ে যা চোখে পড়ার মতো। কেউ পরিবার নিয়ে আসছে আবার কেউ বন্ধুদের সাথে, একটু দূরে আলোর পাশ কাটিয়ে জুটি বেঁধে বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। হাতে হাত রেখে গল্পে মগ্ধ সবাই। আবার দেখলাম কিছু বাইকার ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সেই পাল্লা দিয়ে ছুটছে। এদিক ওদিক। ভয়ও লাগছে যেন আবার ওরা পড়ে না যায়। পড়লে তো একেবারে শেষ। কেন যে ছেলেরা এমন করে। অনেককে আবার বিরক্ত হতেও দেখেছি। কি বিশ্রী আওয়াজ বাইকের। শব্দে কান ফেটে যাওয়ার মতো। এমন দৃশ্য দেখছি আড্ডা মারছি গল্প করছি।

রাত তখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। এমন সময় আমাদের কাছে আসলো পান্জাবি পরা ৮-৯ বছরের একটি ছেলে মাথায় টুপি। ভাইয়া চা খাবেন। মুখটা মলিন তবে শান্ত স্বভাবের দেখেই মনে হলো। বেশ মায়ায় ভরা মুখখানি। বলালাম চা খাওয়াবে দাও সবাই খাবো। এর মধ্যে এক লোক এসে বললো সিগারেট আছে তোমার কাছে? বললো আছে। হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগে করে কিছু সিগারেট দেখলাম। লোকটিকে সিগারেট দেয়া শেষ করে আমাদের চা দিবে ব্যাগ থেকে অনটাইম কাপ বের করলো। একেএকে সবাইকে চা দিলো সবাই চা খাচ্ছি আবার কেউ সিগারেট নিলো, কয়েক ব্রান্ডের সিগারেট আছে তার ব্যাগের মধ্যে।

চা খাওয়ার এক ফাঁকে জানতে চাইলাম কি নাম তোমার? বললো মো: মোশাররফ হোসেন। তুমি চা বিক্রি কেন করছো? বললো কি করবো আব্বার ইনকামে হয় না তাই। বাবা কি করে? সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করে মগবাজারে। তুমি কি করো? পড়াশুনা করি। কোথায়? এইতো ভাইয়া নয়াটোলা মডেল কামিল মাদ্রাসায়। কোন শ্রেনীতে? চতুর্থ শ্রেনীতে এবার। কয় ভাই-বোন তোমরা? উত্তরে দুই ভাই তিন বোন। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে আমি সবার ছোট। দুই ভাই আর বাবা ইনকাম করি মা বাসায় থাকে তাকে কিছু করতে দেই না! এ ভাবেই সংসার চলে কোন মতে। জানতে চাইলাম কত ইনকাম করো রোজ? বললো সারাদিন বের ইতে পারি না। পড়াশুনা করি মাদ্রাসায় যেতে হয়তো তাই। সন্ধ্যার পর বের হই। ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ইনকাম করি। চা বাসা থেকে মা বানায়ে দেয় শেষ হলেই বাসায় চলে যাই। এর মধ্যে বেচাকেনা যা হয়। জানতে চাইলাম টাকা কি করো? মায়ের কাছে নিয়ে দেই আমার পড়াশুনা খরচ দেয়। তুমি টাকা রাখো না? বললো না একটাকাও রাখি না। দরকার হলে বলি তখন দেয় কিছু। বললাম তোমার এ কাজ করতে কেমন লাগে? জানালো খুব ভালো। ভিক্ষা করার চেয়ে এটা অনেক সম্মানী কাজ। হাত পাতার চেয়ে নিজের ইনকামে অনেক শান্তি। মোশাররফের কথা শুনে অবাকই হলাম! সত্যি কথাই বলছে সে। বললো এখানে আমার বয়সি অনেকেই ভিক্ষা করে আমি ওদের বলি ভিক্ষাকরিস না। তার চেয়ে কাজ করে চল। কাজ করে নিজের অর্জিত আয়ে চলা উত্তম। ওরা করে না। হাতই পাতে সারাদিন। বড় হয়ে তার ইচ্ছা জানতে চাইলে উত্তরে বললো মাওলানা হতে চায়। এবং সৎ পথে চলতে চায়। আমাদের বিল দিতেই একজন ডাকলেন এই ‘চা’, শুনে ভাইয়া যাই ডাকতাছে… আসসালামুআলাইকুম বলে চলে গেলেন।

ক্ষণিকের আড্ডায় মোশাররফের সাথে গল্পে জমে গেলাম। শুনলাম ওর জীবনের গল্প। যার শৈশবের মধ্যবর্তী সময় মাত্র শুরু হলো তার কিনা এখনই জীবন যুদ্ধে নামার সময়ও হলো। এ বয়সেই বেছে নিতে হলো সংসার ধর্মের একটা অংশ। আবার নিজ রেজগারে পড়াশুনাও করার স্বপ্ন তাঁর বুকে। ওদিকে ভিক্ষাবৃত্তিকেও সে ঘৃণা করে। এ বয়সেই তার এমন চিন্তা-ভাবনা আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে ক্ষণিকটা সময়।

মোশাররফের জীবনের প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ হোক, সুন্দর হোক তাঁর স্বপ্নে আঁকা জীবন।

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930