হ্যালোডেস্ক
সোমবার ৬ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বাংলা গানের অমর কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। গত বছরের ২২ জানুয়ারি চলে গেছেন প্রখ্যাত সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এই জুটি বাংলা গানকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছেন যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ দুজনেই না ফেরার দেশে। এমন শোকাবহ দিনে জেনে নেওয়া যাক এই জুটির বিখ্যাত গান ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি…’ কীভাবে তৈরি হয়েছিল।
১৯৮৪ সালের ৩ আগস্ট। মুক্তি পেল বেলাল আহমেদের চলচ্চিত্র ‘নয়নের আলো’। তখনও এতটা খ্যাতি পাননি এন্ড্রু কিশোর কিংবা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তাদের মাঝে দারুণ বন্ধুত্ব। এন্ড্রু কিশোর থাকেন ফকিরাপুলে। আর বুলবুলের আজিমপুরের বাড়িতে প্রতিদিন গানের আড্ডা বসে। বন্ধুত্ব হলেও এন্ড্রু কিশোর তাঁকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন, বুলবুল তাঁকে বলেন তুই তুই করে। বেলাল আহমেদ তার ছবিতে সুর করার জন্য নতুন কাউকে খুঁজছিলেন। তিনি বেছে নিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। শুরু হয়ে গেল সিনেমার কাজ।
নয়নের আলো ছবির প্রথম গানটি তৈরি হলো ‘আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে, হৃদয় যেখানে’। পুরুষকণ্ঠের শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হলেন এন্ড্রু কিশোর। কিন্তু গানটি ডুয়েট হওয়ায় একজন নারী শিল্পী দরকার। তখন সবেমাত্র একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ গানটি গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন সামিনা চৌধুরী। এন্ড্রু কিশোর তার কথা বললেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তিনি রাজি হলেও সামিনা চৌধুরীর মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়ে গোল বাঁধল। সামিনার মা বললেন, তিনি আগে গানের কথা শুনে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন মেয়ে গাইবে কিনা। এই কথা শুনে রেগেমেগে চলে যেতে চাইলেন আহমেদ ইমতিয়াজ।
এন্ড্রু কিশোর তখন তার বন্ধুকে থামিয়ে সামিনার মাকে গানটার প্রাথমিক রেকর্ড শোনালেন। পছন্দ হলে রেকর্ড হয়ে গেল অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গানটি। এরপর ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গানটি রচনা করতে হবে। পরিচালক বেলাল আহমেদ সিনেমার সিকোয়েনস্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে বুঝিয়ে দিলেন। সাথে সাথে কাগজ-কলম আর গিটার নিয়ে বসে পড়লেন বুলবুল। লিখে ফেললেন কয়েকটি লাইন, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি/ এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না,/ আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো মিটবে না।/ তারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না মন ভরবে না’।
এবার এলো সুর করার পালা। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সুর দিয়ে ফেললেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সুর শুনে তাঁর মা বললেন, ‘মোটামুটি হয়েছে’। বাড়ির গৃহকর্মী বললেন, ‘মামা সুর তো ভালাই করছেন, কিন্তু কঠিন।’ উল্লেখ্য, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তার সুরগুলো বাসার সবাইকে শোনাতেন। মতামত নিতেন। গৃহকর্মীও বাদ যেত না। সুর কঠিন হয়েছে শুনে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভয়ে ভয়ে পরিচালক বেলাল আহমেদকে সেটি শোনালেন। বেলাল আহমেদের পছন্দ হলে শুরু হলো রেকর্ডিংয়ের পালা। কিন্তু সেদিন এন্ড্রু কিশোরের গলার অবস্থা ভালো ছিল না।
প্রথম রেকর্ড চূড়ান্ত হওয়ার পর সেটি এন্ড্রু কিশোরের পছন্দ হলো না। তিনি ভয়ে ভয়ে বেলাল আহমেদকে বললেন আরেকবার রেকর্ড করাতে। বেলাল আহমেদ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘রাখো মিয়া। এইটাই কারেক্ট হইছে। ছবির সিকোয়েন্সে সারা রাত কানতে কানতে নায়কের গলা ধইরা গেছে। সেই ধরা গলায় গান করলে যেমন হইব, এই গানে তোমার কণ্ঠও তা–ই ছিল। এইটাই ঠিক আছে।’ সিনেমার পর্দায় জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল যখন এই গানে ঠোঁট মেলালেন, দর্শকরা যেন পাগল হয়ে গেল! গানটি মানুষের মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, এখনো তা মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
এই গান গেয়ে বিখ্যাত হয়ে যান এন্ড্রু কিশোর। বিখ্যাত হয়ে যান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এই গানের জন্য এন্ড্রু কিশোর ১৯৮৪ সালে শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন। এই গানের সঙ্গে জড়িত দুটি মানুষ আজ আর নেই। এই গানগুলোর মাঝেই অমর হয়ে থাকবেন তারা। মানুষের মুখে মুখে আরও বহু যুগ ফিরে ফিরে আসবে ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি…।’
Add Comment