সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-মিলন মাহমুদ রবি
অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরছি তখন মধ্যরাত। স্বাভাবিক নিয়মে রাতের ঢাকায় অসংখ্য গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। কিন্তু বৈশ্বিক এই করোনা মহামারিতে যেখানে নিরবতা পালন করছে গোটা বিশ্ব সেখানে বাংলাদেশও কম যায়নি। গাড়ির গ্লাস থেকে যখন রাতের ঢাকা চোখে পড়ে তখন হাত-পা অবশ হয়ে আসতে থাকে। বেশ কয়েক যায়গায় পুলিশের চেকপোষ্ট আর দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে পুলিশের টহল গাড়ি। এমন ফাঁকা শহর আমার জীবনে দেখা হয়নি! এটাই প্রথম। মনে হচ্ছে সুনশান এক নিরবতা পালন করছে প্রতিটি সড়ক…!
যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন রাত ২:২০ মিনিট টিনিট হবে। বাসার সামনের রাস্তা ভাঙ্গা থাকায় বেশ কিছু পথ হেঁটেই যেতে হয়। এলাকায় ডুকতেই মনে হলো যুদ্ধ চলা কোন এক শহরে দাঁড়িয়ে। আমার চারপাশে ভয়ঙ্কর এক নীরবতা। নিস্তব্ধ মহল্লা। এত রাতে কংক্রিট শহরের মানুষগুলো নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে।
শুনেছি ৭১’র যুদ্ধেও নাকি পাকহানাদার বাহিনীর ভয়ে এদেশের মানুষ লুকিয়ে বেড়াতো। ভয়ে কেউ বের হতো না। জীবন হাতে নিয়ে চলতে হতো প্রতিটি মানুষকে। সেসময় রাস্তাঘাট, পাড়া- মহল্লা এমন নিরব থাকতো। পাকিদের নির্যাতনের ইতিহাস শুনলে চোখটা এখনও ভিজে আসে। ওদিকে আর না যাই, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। তার চেয়েও ভয়াবহ এক যুদ্ধ করছি বর্তমান প্রজন্ম। সারাবিশ্ব আজ এ যুদ্ধের আওতাভূক্ত। অদৃশ্য এক প্রতিপক্ষের কাছে। সবাই আজ গৃহবন্দি। সারা বিশ্বের আজ একটাই স্লোগান ‘ঘরে থাকুন’। এমন অনেক ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায় আর হাঁটছি…।
মাঝেমধ্যে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছি সমাধান করে দাও প্রভু। আমরা আশ্রয়ের অপেক্ষায় আছি। সিটি কর্পোরেশনের রাস্তার সব লাইটগুলো বেশকিছুদিন ধরে জ্বলতে দেখছি না। অন্ধকারে ঘীরে থাকে কিছু কিছু যায়গা। কুকুরগুলো চুপচাপ শুয়ে আছে। প্রতিনিয়ত যাওয়া আসায় ওরা আমাকে চিনে ফেলেছে। ঘেউ ঘেউ করে না তেমন। ভিতরে একটু আধটু ‘ভয়’ও করছে।
ভাবছি বর্তমান সময়টা মিথ্যা নয়। সবাই আজ ‘মৃত্যু’ নামক এক শব্দের কাছে আটকে গেছে। দেখতেও পাচ্ছি মৃত্যুর হাতছানি আমার আশেপাশে বেশ জোড়ালো। ওৎ পেতে অপেক্ষা করছে মৃত্যু, তাঁর নিয়মের অপেক্ষায়!! একটু খেয়াল করলে বুঝা যায় ব্যস্ততম এ শহরের প্রতিটি মানুষের চোখ আজ মৃত্যু ভয়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে আছে। এমন যুদ্ধ কয়েকটা প্রজন্ম দেখেছে কি না ইতিহাস থেকে জানতে পাইনি।
এমন ভয় সাথে নিয়েই হেঁটে চলছি। পাশের বাড়িটি ‘লকডাউন’ দু’দিন ধরে। করোনা আক্রান্ত দু’জনকে পাওয়ায় আশেপাশের কয়েকটি বাড়ি ‘লকডাউন’ করেছে প্রসাশন। এমন সময় দূর থেকে চোখে টর্চ লাইট এসে পড়লো, সাথে বাঁশি! তাদের দেখে একটু সাহস হলো। অন্তত কারো দেখা পেলাম।
নৈশ প্রহরী ওনারা। অফিস ফেরার পথে তাদের সাথে দেখা হয়, কথাও হয়। প্রহরী দু’জনই বয়স্ক। কাছে যেতেই বললো বাবা কেমন আছেন। আজ খবর কী? বললাম চাচা ভালো আছি। সারাদিনের সংক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা জানালাম। তাঁদের চোখে মুখেও মৃত্যুর ছাপ পড়ে আছে আর আল্লাহকে ডাকছে। একজন বললো বাবা আজ কয়জন ত্রাণ চোর ধরলো।
শুনে লুকোনো হাসি দিলাম। একজনতো চোরের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেললো। বললো বাবা সারারাত খুব কম টাকায় পাহারা দেই এই বয়সেও। আজ গরীবের খাবার এসব নেতারা চুরি কইরা খায় আল্লায় সইবো না। বঙ্গবন্ধু এ চোরগো ভালো করতে পারলো না, শেষমেশ লোকটারে মাইরা ফালাইলো। শেখ হাসিনা কী পারবো?? বললো মানুষ কত অসহায়, রাতে ডিউটি করি আমরা জানি…! আরো বললো ওরা মানুষ না ‘জারজ’ সন্তান।
বললাম চাচা পরিবর্তন হবে দেখতে পাবেন। বললো দেখে যেতে পারবো না। কিছুটা দেখতে পাচ্ছেন তো। সরকার তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই যে চোরদের ধরতেছে। আজ দেখেন পুলিশ, সেনাবাহিনী কতটা কষ্ট করে দেশকে পাহাড়া দিয়ে রাখছে। আপনারাও কম করছেন না। দেখেন কোথায় আজ সারা বিশ্বে লেগে থাকা যুদ্ধ। বিশ্বের বড় বড় নেতারা সবাই বাঁচার জন্য আজ ঘরবন্দি। আমাদের নেতাদের কোথায় সেই দাম্ভিকতা আর বড় বড় সব ভুলি। চুপ মেরে গেছে। লুকিয়ে ঘরের মধ্যে। জনগণের পাশে নেই তাই চাপাবাজিও নেই। দেখতে পাচ্ছেনতো বলতে বলতে বাড়ির গেটের সামনে চলে আসলাম। গেট খুলে ভিতরে ডুকে বললাম চাচা হতাশ হয়েন না। হতাশা সমাধান নয়। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আঁধারের পর আলো আসবে এটাই নিয়ম। আবার নতুন যাত্রা শুরু হবে এই পৃথিবীর। সুদিন খুব দূরে না, কাছেই; তবে ‘ভয়’ নামক শব্দটি বেঁচে থাকুক প্রতিটি মানুষের কাছে। যুগযুগ ধরে…।
Add Comment