হ্যালোডেস্ক
‘সতী’ শব্দটির উৎস
‘সতী’ নামটা এসেছিল দেবী সতী থেকে। তিনি ছিলেন রাজা দক্ষের কন্যা, একইসাথে দেবাদিদেব শিবের স্ত্রী। দক্ষ মেনে নিতে পারেননি তার মেয়ে কোনো শ্মশানবাসী ভবঘুরেকে বিয়ে করবে। একদিন সতীর সামনেই শিবকে কঠোর ভাষায় দক্ষ তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য না করতে পেরে সতী আত্মহনন করেন। মৃত স্বামীর সাথে চিতায় ওঠার এই প্রথার নাম সতী লিখেছিলেন এংলো-ইন্ডিয়ান লেখকরা। আসলে একে বলা হত ‘সহগমন’, ‘সহমরণ’ বা ‘সতীদাহ’। ‘সতীব্রত’ বলে এক প্রথা চালু ছিল, যেখানে নারী তার স্বামীকে কথা দিত, স্বামী যদি আগে গত হয়, তবে সেও সহমরণে যাবে। সতীপ্রথা পালন করা হলে নারীকে বলা হত ‘সতীমাতা’।
সতীদাহ প্রথার প্রচলন
সতীদাহের কোনো আদেশ বেদে নেই বলে জানা যায়, বরং মরণোত্তর স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবন পার করতেও বলা হয়েছে। সনাতন ধর্মের পুরাণে বহু চরিত্র আছেন যারা স্বামীর মৃত্যুর পর বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সহমরণ কোনো নতুন বিষয় ছিল না, এমনও নয় যে ভারতে প্রথম এমন প্রথা চালু হয়েছিল, কিংবা ভারতকে দিয়েই শেষ হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের সহমরণের বর্ণনাও পাওয়া গেছে। তাহলে কিভাবে সতীদাহ এত প্রচলিত হয়ে পড়লো?
কোনো পরিবার থেকে একজন নারী সতী হওয়া মানে বিরাট সম্মানের বিষয়। একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত অধীনতা, সতীত্ব ও ধর্মপরায়ণতার লক্ষণ ছিল এই প্রথা। ছেলের মৃত্যুর পর তার বউ বাড়িতে থাকা আলাদা একটা বোঝার মতোন ছিল। স্বভাবতই সব পরিবার চাইত তাদের বউটিও সহমরণে গিয়ে তার এই স্বল্পদামী জীবনের বিনিময়ে পরিবারের সম্মান বাড়াক।
কিন্তু দেখা যেত অনেক ছোট বয়সে বিধবা হয়ে গেছে, স্বামীর মৃত্যুতে হতবিহবল হলেও শোকের মাতম তোলার কারণ নেই। আবার বউটি বেশ বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন। পরলোকের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বড় তার কাছে আরো কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকা। এমন সব নারীরা চিতায় ওঠার আগে বেঁকে বসতো। আসলে খুব কম নারীই ছিল যারা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে পরলোকের মোহে পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেত। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদত, ছেড়ে দিতে বলত। এই আওয়াজ যেন কেউ না শোনে তাই শবযাত্রীরা ঢোল, মাদল, বাঁশির আওয়াজে ভরিয়ে তুলত। অনিচ্ছুক মেয়েদের খাওয়ানো হত আফিম জাতীয় ওষুধ, যেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাউকে মাথার পেছন দিকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলা হত। লক্ষ্য রাখা হত আঘাত আবার এত জোরে না হয় যাতে মেয়েটা মরেই যায়। রীতি অনুযায়ী জীবিত পোড়াতে হবে। তাহলেই স্ত্রী পরবর্তী জন্মে উঁচু বংশে জন্মাতে পারবে, ভাগ্য ভালো হলে এই স্বামীর স্ত্রী হয়েই। পরের জন্মে সম্মান অথবা সমাজে দর্প করে বেড়ানোর আশায় ১৫০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত কয়েক হাজার নারীকে জীবিত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর চিতায়।
নিয়ম – রীতি
সহমরণে যাওয়ার কিছু নিয়ম ছিল। এর মাঝে ছিল যারা সহমরণে যেতে পারবে না তাদের তালিকা- যদি কোনো নারীর সন্তান এতই ছোট হয় যে নিজের দেখাশোনা করতে পারে না, যদি কোনো নারী মাসিক চলার সময়ে থাকেন, যদি তার গর্ভে বাচ্চা থাকে। মুঘল শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে সহমরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন সম্রাটরা, বাদ সাধলো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগ। শিশুর মাকে সহমরণে যেতে না দেওয়ার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। বাদশাহরা নিয়ম করেন, কাউকে দিয়ে সতীদাহ পালন করাতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু বাদশাহরা যেহেতু মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে নামতেন না, প্রজাদের সুখ দুঃখের সাথে মিশে যেতে পারতেন না, স্বামীর পরিবার ঘুষ দিয়ে অনুমতি আদায় করে নিত।
সতীদাহ রদ
সতীদাহ প্রথাকে রুখতে যে দু’জন ব্যেক্তি সোচ্চার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যো প্রথম জন হলেন ব্যারপ্টিস্ট মিশনারী উইলিয়াম কেরি এবং দ্বিতীয় জন রাজা রামমোহন রায়।
উইলিয়াম কেরি
উইলিয়াম কেরি ছিলেন একজন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী, এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। ১৭৯৯ সালে তার এক নারীর সহমরণ দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই দৃশ্যে তার আত্মা কেঁপে ওঠে। এই আচার বন্ধ না করা পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন না ঠিক করেন। তিনি ও তার দুই সহকর্মী জোশু মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড মিলে সতীদাহ বন্ধের জন্য উপর মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তারা সতীদাহের সমস্ত বিবরণ উল্লেখ করে সতীদাহ বিরোধী নিবন্ধ লিখে পাঠান।
রাজা রামমোহন রায়
১৮১২ সালে রামমোহন রায় সতীদাহবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তিনি দেখেছিলেন তার বৌদিকে জোর করে চিতায় তুলতে। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে তিনি মৃতের বাড়ির লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই কাজে আরো অনেক অনুসারী জুটিয়ে নেওয়া কষ্টের ছিল না। এদের মাঝে দল তৈরি করে দেন, যাতে তারাও বিভিন্ন শ্মশানে যেত।
উইলিয়াম কেরি আর রামমোহন রায়দের মতো মানুষ না আসলে এই ভয়ংকর প্রথা হয়তো আরও অনেক দশক পর্যন্ত চলমান থাকতো।
আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন। হ্যালোটুডে’র ইতিহাস বিভাগে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন, আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখা দিয়ে। হ্যালোটুডে আপনার মনের কথা বলে।
Add Comment