গল্প

সুঁই সুতার ফোঁড়ের মাঝে পঞ্চাশ বছর !

আব্দুল মতিন ও এক কাষ্টমার

সাময়িকী : শুক্র ও শনিবার

২৩ ডিসেম্বর ২০২১


―মিলন মাহমুদ রবি

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার ইন্দ্রিরা রোড হয়ে দিনের বেলায় যেতেই যে কারো চোখে পড়বে আব্দুল মতিনের খোলামেলা এই টেইলার্সটি! রাস্তার বাঁকে এভাবেই বসে সেলাইয়ের কাজ করছেন দেশ স্বাধীনের পর থেকে। তার দোকানটিতে নেই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, নেই সিলিং, চাল কিম্বা টিনের চালার বালাই পর্যন্ত নেই। খোলা আকাশের নিচে এভাবেই বছরের পর বছর পার করছেন। কি রোদ, কি বৃষ্টি সব কিছুকেই যেন তুরি―মেরে উড়িয়ে দেন তিনি। তবে বর্ষার মৌসুমে পলিথিন দিয়ে কিছুটা ঘিরে নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে সেই সুযোগটাও তার থাকে না।

এ পথে যাতায়াতের সুবাধে প্রায় এক যুগের উপরে আমি―ই তাকে দেখে আসছি! মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলার কৌতুহল জাগতো। বলি বলি করে আমারও পার হয়ে গেলো অনেক বছর। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। তবে ইচ্ছে ছিলো সময় করে কথা বলবো। হঠাৎ একদিন কি মনে করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে আলাপ জমাতে শুরু করলাম।

পটুয়াখালি জেলার মের্দাগঞ্জ থানার আনজুয়া গ্রামের নিবাসী রশিদ আকন্দের ছেলে আব্দুল মতিন (৮০) তিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ এই মানুষটি পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে এখনো সুঁই-সুতার সাথে সন্ধি করে নীরবে দিন পার করছেন। বাড়িতে স্ত্রী ও ২ছেলে ২মেয়ে রয়েছে। দেশ ভাগের পর অভাব ঘোচাতে কাজের উদ্দ্যেশে নিজ গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নেন পিচঢালা শহরটিতে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতায় ঘিরে থাকা মানুষটি পরিবার রেখে চলে আসেন ঢাকায়। তেমন কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে আগে থেকে জানা কাজকে পুঁজি হিসেবে নিয়ে নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে। অস্ত্র বলতে একটি পুরনো ‘সেলাই মেশিন’।

সেই থেকে একই যায়গায় বসে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে তার দোকানের জন্য কোন ভাড়া গুনতে হয় না। সকাল ৯ টার পর থেকে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত খোলা থাকে তার দোকানটি। প্রকৃতির কাছ থেকে ধার করা আলোতে কাজ করেন বিধায় দিতে হয় না কোন বিদ্যুৎ বিল! টুকিটাকি কাজ নিয়ে আসেন নানান কাস্টমার। তার কাছে অধিকাংশ গার্মেন্টস কর্মী, আশেপাশের বাড়িতে কাজ করা গৃহকর্মী, রিক্সা চালকসহ অল্প আয়ের মানুষরা কাজ নিয়ে আসেন। আবার আশেপাশের বাড়িওয়ালারাও টুকিটাকি কাজ দিয়ে পাঠান। এমন অনেক বাড়ির মালিকদের কাছে মাঝেমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন তিনি। তাদের ছোট ছোট কাজের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন আব্দুল মতিন।

কাজ করাতে আসা এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয় আমারও। তেমনই একজন ময়মনসিংহের সুফিয়া বেগম। তিনি বলেন, কম টাকায় কাজ করাতে পারি বলেই চাচার কাছে আসি। মতিন চাচা অনেক ভালো মানুষ, কাজও করে ভালো। আমিও অনেক বছর এই এলাকায়, চাচাকে এখানে বসেই কাজ করতে দেখি।

‘সেলাই দাদা ভাই’ নামে ডাকলাম তাকে। শুনে খুব খুশি হলেন। বললাম একটা দোকান ভাড়া নেন না কেন? অনেক বছর ধরে একই যায়গায় বসে কাজ করতে দেখছি। হতাশার কণ্ঠে বললেন, ‘দোকান ভাড়া নিয়ে টেইলার্স করার ক্ষমতা এহনো হয় নায়, একদিন বইলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা উপার্জন করতে পারি। মাসের মধ্যে সবদিন বইতে পারি না। তাতে যা রোজগার হয়, নিজে থাইক্কা বাড়িতে যা পাডাই হেইয়া দিয়া সংসার চালানো কষ্ট হইয়া যায় বউডার। মাইয়া-পোয়া কয়ডা স্কুলে যায় হেয়াতে খরচ আছে। টাহা কই পামু এতো, বাপের তেমন জমিজমাও নাই যে বিক্রি কইরা কিছু করমু’।

পরিবার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ছলছল চোখে বলেন, গরীবের ভরসা আল্লাহ। সবার মতো আমারো বউ, পোলাপানের লগে থাকতে মন চায়। বোঝেন না, পারি না ক্যান? কি করমু এই কাজ ছাড়া কোন কাজ পারি না। টাহা ইনকামের জন্যই থাকতে হয়। বয়স হইছে শক্তিতে কুলায় না আর। মেশিনে আর পাও দেতে মন চায় না। তা, বাবা আপনি এতো কথা জিগান ক্যা। কি হরবেন? বললাম, চাচা এমনিতেই জানতে হচ্ছে হলো তাই। বললো অনেকে আসে হুনতে চায়, হেইয়ার পর চইলা যায়। অনেক পুলিশ আসে, আইসা হোনে মোর গল্প। সবাই মোরে খুব ভালো জানে। কারোর লগে কোনদিন মোর কোন গ্যানজাম হয় নায়।

আব্দুল মতিন এখানের একটি মেসে থাকেন। পরিবার নিয়ে থাকার আনন্দটুকু ভুলতে বসেছেন তিনি। তারপরও প্রতিটি পুরুষ তাঁর পরিবারের কাছে একটা বট গাছের মতো। বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত পুরুষটি তার পরিবারের জন্য শেষ ছাঁয়াটুকু ভাগ করে দিতে চেষ্টা করেন।

সেলাই মেশিনের চাকায় স্বপ্ন দেখা মানুষটি পুরা জীবন কাটিয়ে দিলেন এই শহরে। প্রায় ৫০ বছর একই পেশায় কাজ করে জীবন চাকা সচল রেখেছেন। হয়তো তার চোখের জমা স্বপ্নগুলি এত বছরে দীর্ঘ হয়েছে। জমানো স্বপ্নগুলো পূরণ হবে কি না জানা নেই তার। খোলা আকাশটাকে এখন ভরসা মনে করেন তিনি। সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে ফোঁড়ে স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা আব্দুল মতিনের জীবনে বেশি চাহিদার প্রয়োজন হয়নি। মেটানো সম্ভব-ও হয়নি। যতটুকু পেয়েছে তার মধ্যে-ই শান্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছে। তবুও বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে প্রতিটিদিন পার করছেন সংগ্রামী আব্দুল মতিন।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031