-মিলন মাহমুদ রবি
সারাক্ষণ শুধু ফোনে কথা। মেসেজ চালাচালি। ফোনটা কান থেকে নামেই না। এত কী করে পারে সারাক্ষণ। কী এত কথা বন্ধুদের সঙ্গে! বন্ধুদের সঙ্গে এখানে-সেখানে যাওয়ার বা কী দরকার! কলেজ পার্টি, কারো জন্মদিন—যখন তখন হুটহাট বেড়িয়ে পড়া; কখনও বা কয়েকজন বন্ধু জুটিয়ে বলা নেই কওয়া নেই চলে যাচ্ছে বান্দরবান বা সুন্দরবন—প্রথম যৌবনেই এতটা স্বাধীনতা কি দেওয়া উচিত? সন্তানরা ভাবেন বয়সতো এখনই। কিন্তু মা-বাবা বা অভিভাবক সন্তানদের নিয়ে এমনটা দুশ্চিন্তা করবেন, সেটা অস্বাভাবিক নয়।
আবার সন্তানদের কাছে থাকে উল্টো যুক্তিও। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কিংবা দল বেঁধে বেড়াতে ও ঘুরতে যাওয়া তো বখে যাওয়া নয়। বরং দেশকে জানতে হবে দেখতে হবে চারপাশ। ইট-কাঠের নগরে বন্দী কারাগারের জীবন মানেই ননির পুতুল বা কাঠপুতুল হয়ে বড় হওয়া। মা-বাবা কেবল সেটাই চান! সন্তানরা মা-বাবাকে এমন দোষ দিয়ে থাকেন।
মা-বাবা, অভিভাবক ও সন্তান—দুই পক্ষের বক্তব্যেই আছে নানা যুক্তি। কিন্তু এতে আছে দুই প্রজন্মের দুই রকম করে দেখা ও জানার ভঙ্গি। অভিভাবকরা যেমন ভাবেন, শৈশব-কৈশোর পেরোনো যৌবনমাত্রই নিরাপদ নয়। পায়ে পায়ে থাকে বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা। কোনো বিপদ ঘটে কি না, এমন দুশ্চিন্তা মা-বাবার থাকে সর্বক্ষণ। হারিয়ে যেতে মানা করার মধ্যে বাধা দেওয়ার চেয়ে সন্তানের প্রতি মা–বাবার মঙ্গলচিন্তাটাই বেশি কাজ করে।
তাঁদের এমনও চিন্তা হয়, সন্তান কেন এত সাহসী হবে, তার এত স্বাধীনতা কেন দরকার—সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ও নতুন প্রজন্মের চাহিদা ও স্বপ্নের সঙ্গে একমত হতে পারেন না অনেক মা-বাবাই।
বাঁধ ভাঙা স্বপ্ন যখন চোখের কোনে
কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দেওয়ার সময়ে সবার মধ্যে স্বাধীনচেতা ভাব চলে আসে। অনেক কিছু পারি; অনেক কিছু জানি, নিজের বুঝে নিজে চলতে পারব। সিদ্ধান্ত নিতে কারও সাহায্য লাগবে না। কোনো সমস্যা হবে না। সন্তানদের এ রকম চেতনা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢোকার পরপরই সবার মধ্যে কমবেশি দেখা যায়। কেউ প্রকাশ করে; কেউ করে না। নতুন পরিবেশ সবার চোখে ও মনে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে যায়। সবাই নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলার অনন্ত চেষ্টা করে চলে। সেটা পোশাক-আশাকে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, এমনকি ক্লাসে পারফরম্যান্সের মাধ্যমেও। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাস্যকর ঘটনাও ঘটে প্রচুর। প্রথম যৌবন মানেই জীবনের উদ্বোধন। যৌবন মানেই খাপ খোলা তলোয়ার। আসলে এই সময়টা সত্যিই বাঁধনহারা। নতুন চলার পথ, নতুন সম্ভাবনা, রঙিন স্বপ্নময় নতুন পরিবেশ পেয়ে সন্তানরা বাঁধভাঙ্গা হয়ে যায় অনেকটা। এমন অবস্থায় মা-বাবার সন্তানদের নিয়ে চিন্তার আর শেষ থাকে না।
কোন কোন সন্তানরা এই সময়টা চায় নিজের মতো করে থাকতে। একটু আলাদা আয়নায় নিজেকে দেখতে। কেউ কোউ হোস্টেলে থাকতে চান, বন্ধুদের সাথে সময় পার করার জন্য। কেউ ভাবেন হোস্টেলের জীবনের একটা আলাদা আমেজ আছে। পরিবারের নিত্যদিনের গণ্ডির বাইরে নতুন এক জীবন। আবাসিক হলের জীবন আরও অন্য রকম। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পরে সবাই খাপ খাইয়ে নেয়। আর যারা বাসায় থেকে পড়াশোনা করে, তাদের আর এই জীবনের মজা পাওয়া হয় না। তারপরও অনেকে পরীক্ষার অজুহাতে মাঝেমধ্যে হলে চলে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে রাত জেগে পড়তে হবে। কেউ বা চলে যায় বন্ধুর বাসাতেও। মা-বাবার জন্য এটা মস্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। তাঁরা বলেন বাসায় বসে পড়ালেখা করলে দোষ কী। সন্তান কৌশলে বন্ধুর বাসায় রাত কাটানোর সুযোগ নিচ্ছে কি না, সেই সন্দেহও পেয়ে বসে।
প্রেমে পড়া নতুন ঘটনা নয়
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রেমে পড়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্পর্ক কতখানি জোরদার হবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কেউ কেউ এক সম্পর্ক ছেড়ে আরেক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কাকে ধরি কাকে ছাড়ি; শ্যাম রাখি না কুল রাখি—এ রকম দোটানায় পড়ে যায় অনেকে। প্রেম সমস্যা নয়। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসাজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ঘিরে নানা সমস্যার জন্ম।
ছেলেমেয়েরা এখন ফার্মের মুরগির মতো বড় হয়। চারদেয়ালে ঘেরা আবদ্ধে বড় হতে হয় সন্তানদের। সবকিছু হাতের কাছে পায়। নড়াচড়া কম। বাস্তব জীবনকে যথার্থভাবে মোকাবিলা করতে পারবে কি না, মা-বাবা এ আশঙ্কায় থাকে। তা থেকে নানা রকম দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনার জন্ম। একদিকে সন্তানের বাস্তবমুখী সমৃদ্ধ জীবন যেমন কামনা করেন, অন্যদিকে সন্তানের মঙ্গলের জন্য নানা রকম সাবধানতার কথাও সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খায়। এমন অবস্থায় বাড়ে দূরত্ব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কিছু সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করে।
অভিভাবকদের করণীয়
মনোবিজ্ঞানী-চিকিৎসকেরা বলেন, মনকে শিকল পরানো যায় না। শৃঙ্খলিত করা যায় না মনোবৃত্তিকেও। সময়ের চাহিদা ও বিকশিত নতুনত্বের বিষয়টিকে আমলে নিতেই হবে। সন্তানকে শৈশব থেকেই দিতে হবে ভালো-মন্দের শিক্ষা। চারদেয়ালের মধ্যে না রেখে বা পুতুল হিসেবে বড় না করে শৈশব থেকেই স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠার অভ্যাস করানো উচিত। তাহলে তাঁরা হঠাৎ স্বাধীনতা বা নতুন কোন পরিবেশে সে হাবুডুবু খাবে না। বরং নিজেকে সামলে নিতে পারবে। খাপ খাওয়াতে পারবে পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে হলেও পরিস্থিতি সামলে নিয়ে চলতে পারবে বাঁকা পথগুলো। এছাড়া মা-বাবার উচিত-
* সন্তানের অতিরিক্ত স্বাধীনতা, যেমন প্রশ্রয় দেবেন না। তেমনি তার স্বাভাবিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করবেন না।
* তাদের মুক্তভাবে চলার অবকাশ দিন। কথায় কথায় সন্দেহ নয়।
* অনেক মা-বাবাই বন্ধু-বান্ধবীদের বাসায় আসা সমর্থন করেন না। বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের হলে কথাই নেই। এটা না করে তাদেরকে সহজ-মানবিকভাবে মিশতে দিন। বন্ধুত্ব নির্মল ও নিষ্কলুষ।
সন্তানদের করণীয়
* মা-বাবার পরামর্শ মানেই প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য বড় কিছু, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আধুনিক মা-বাবা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন।
* মা-বাবা বা অভিভাবককে বৈরী ভাবার কোনো কারণ নেই। তারাই প্রকৃত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। যেখানে মতের অমিল, সেটা দুই পক্ষ একে অপরকে বুঝিয়ে সুরাহা অবশ্যই সম্ভব।
* মা-বাবার কাছে লুকানোর কিছু নেই। তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করা বা কোন জটিলতায় পড়লে মা-বাবার সাথে অলোচনা করে নেয়াই মঙ্গল।
* সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এটাই স্বাভাবিক; কারা কারা বন্ধু—সেটা অভিভাবক জানলেই ভালো। তাতে নিরাপত্তাবলয়টা মজবুত হয়।
সন্তানদের বাঁধন হারা হলে সমস্যা নেই এমনটা যারা ভাবেন তাঁরা বর্তমান সমাজের হালচাল না বুঝেই হয়তো বলেন। কোন কোন সময় রঙিন পথে নেমে আসতে পারে কালো আঁধার। তাই সময় ও পরিস্থিতি বুঝে সামলে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আর মা-বাবাতো সকল সন্তানের জন্য চিন্তার সাগর। তাঁরা চিন্তা না করলে কারা করবে। সন্তানদের নিয়ে চিন্তার শেষ থাকে না প্রতিটি মা-বাবার। সন্তানদের ভাল-মন্ধ দেখার দায়িত্ব তাঁদের উপরই বর্তায়।
Add Comment