সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-মিলন মাহমুদ রবি
যতটুকু মনে পড়ে তখন আমি ৪র্থ কিম্বা ৫ম শ্রেনীতে পড়ি। আমাদের প্রাইভেট পড়াতে বাসায় একজন শিক্ষক ঠিক করা ছিলো খায়রুল আলম নাম তাঁর। স্যার ছোট বেলা থেকেই আমাদের তিন ভাই-বোনকে পড়াতেন। আমাদের খুব যত্ন করতেন। দীর্ঘদিন এক শিক্ষকের কাছে পড়ার কারণে সম্পর্কটাও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। পরিবারের একজন সদস্য ছিলেন তিনি।
তৎকালীন বিরোধী দল টানা ক’দিন হরতাল ডাকায়, স্যার এক বিকেলে এসে মাকে বললো ভাবি আজ পড়াবো না, দুইদিন গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসি। মিলনকেও সাথে নিয়ে যাই। মা মুখের উপর না করতে পারলেন না। মা বললো ওকে সামলাতে পারবেনতো ভাই। বললো সমস্যা নাই। স্যারদের গ্রাম খুলনা শহর থেকে ১৫/২০ কিলোমিটার দক্ষিনে, ডুমুরিয়া উপজেলায়। আমাকে রেডি করছেন মা। আমারতো খু্ব আনন্দ। ছোট বেলা থেকেই শহরে বেড়ে ওঠা আমাদের। গ্রামে ঘুরতে যাবো এটা অনেক আনন্দের ছিলো। আমার বরাবরই খোলা আকাশ, চিরসবুজ গ্রাম-বাংলা পছন্দ। যাই হোক― মা আমাকে রেডি করে দিলেন আমরা রওনা দিলাম। পৌঁছাতে সূর্য ডুবে গেলো। রাতে খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে স্যারদের বাড়ির পুকুরপাড়ে বসে মাছ ধরা দেখছি। স্যারের ছোট ভাই মাছ ধরছে, মেহমানদারি করতে হবে তাই। আবার স্যারের বাবাকে দেখছি গরুর দুধ দোয়াচ্ছে। ওখানকার অধিকাংশ ঘর মাটির তৈরি। আমিতো দেখে অবাক এগুলো আবার কেমন ঘর। আশেপাশের বাড়ি থেকে আমার মত ছেলে মেয়েরা আসছে, শুনেছে শহর থেকে আসছি তাই দেখতে। ওদের সাথে খেলছি, কথা বলছি, বেশ আনন্দ লাগছে। মার পড়াশুনা করার জন্য প্যাঁ-প্যাঁ আওয়াজ কানের সামনে নেই…!
দুপুরে সবাই মিলে খেতে বসছি। স্যারের মা বলে বসলো― বাবা তরকারি দিয়ে সব ভাত খেয়ো না, দুধ, মিষ্টি আছে। বললাম আচ্ছা আন্টি। একটু পরে দুধ আর একটা প্লেটে ‘চিনি’ নিয়ে আসলো। আন্টি আমার পাতে দুধ আর চিনি দিলো, আমি অল্প অল্প করে খাচ্ছি আর মিষ্টির আসার অপেক্ষায় আছি―, মিষ্টি কেন আনছে না! কারণ মিষ্টি বলতে রসোগোল্লা বা গোলগোল এগুলোই চিনতাম। পরে দেখলাম সবাই এভাবেই খাচ্ছে। পরে ভেবে নিলাম চিনিই তাদের মিষ্টি। হঠাৎ স্যার তার ছোট ভাইকে বলছে (নাম মনে নেই) মিলনকে নিয়ে বিকেলে হেলিকপ্টারে করে ঘুরায়ে নিয়ে আসিস। হেলিকপ্টারের কথা শুনেতো মনে মনে আনন্দে আটখানা। মিষ্টির কথা ভুলেই গেছি!
খাওয়া শেষে সবাই ঘুম। আমি রেডি হয়ে বসে আছি― আর মনে মনে স্বপ্ন আঁকছি। আর একটু পরেই হেলিকপ্টার আমায় নিতে আসবে। আকাশে উড়বো কি মজা হবে। উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে কেমন দেখাবে। এমন নানান ভাবনা নিয়ে ভাবছি কখন আনবে উনি। বেশ কিছু পর আমাকে ডাকলেন, আমি বের হয়ে দেখলাম একটা ‘সাইকেল’ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে বাড়ির উঠোনে! সাইকেলের পিছনে একটা লম্বা তক্তা বাঁধা। আমাকে উঠতে বললো, উঠে পড়লাম। সে চালানো শুরু করলো। আমি ভাবলাম হয়তো ফাঁকা কোন মাঠে হেলিকপ্টার রাখা আছে সেখানে গিয়ে উঠবো!
আমাকে নিয়ে গেলেন মাছের ঘেরে, সেখানে বিশাল ঘের। অনেকে ঘেরে মাছ ধরছে, এসব তিনি দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমারতো আর সইছে না। মাছ ধরা দেখে কি করবো? ভয়ে, লজ্জায় বলতেও পারছি না। কোথায় সেই ‘হেলিকপ্টার’? যাতে চড়ে আকাশে উঠবো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সবাই মাছ ধরা শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু হেলিকপ্টার আসছে না কেন? এমন সময় বললো চলো বাড়ি যাই। সাইকেলে চড়ে বসলাম। পিছনে বসে আমার বুক ফাঁটা কষ্ট কে দেখে? না পেরে বললাম আঙ্কেল হেলিকপ্টার আসলো না যে? তিনি বললেন, বোকা এটাই হেলিকপ্টার। আমরা সাইকেলকে হেলিকপ্টার বলি। শুনে নায়ক মান্নার ‘কষ্ট’ সিনেমার মতো কষ্টে বুক ফেটে কান্না বের হতে যেয়েও হচ্ছে না। যেন সব স্বপ্ন ভেঙে পড়লো মাথার উপর। ভাবছি বাড়ি ফিরে মা’র কাছে বিচার দিবো! এ কেমন ধোঁকা দেওয়া হলো?
যারা দক্ষিন অঞ্চল যেমন― ডুমুরিয়া, চুকনগর, সাতক্ষীরা সম্পর্কে জানেন, তারা বুঝবেন এখন আছে কিনা জানিনা, তবে তখন প্রতি বাড়িতে একটা করে সাইকেল থাকতো পিছনে তক্তা বাঁধা। যা হেলিকপ্টার নামে পরিচিত! এটা তাদের বড় বাহন ছিলো। ২০০০’র পরেও দেখেছি। গরুর ঘাস ও হাট থেকে বাজার-সদায় করার জন্য এমনকি এ বাহনটি করে ভাড়াও মারতো। এখনও আকাশে ডানা মেলে হেলিকপ্টার উড়তে দেখলে সেই ভাঙা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে…!
গল্পটা বলার উদ্দেশ্য হলো, লকডাউন ছাড়ার পরপরই, শিল্পপতি ও দূর্নীতিবাজরা যে হারা বিমান রিজার্ভ করে দেশ ত্যাগ করতে ছিলো তখন ভাবতে ছিলাম― এটা কি আমার মতো ধোঁকা খাওয়া অন্য কোন বাহনের নাম, না কি? কারণ, ক্যামনে ধুমায়ে বিমান রিজার্ভ করে লোকজন যাচ্ছে? পরে ভেবে দেখলাম আমার স্বপ্ন আর তাদের বিমান নিয়ে আকাশে ওড়া এটা কী এক হলো? তারাতো চাইলে― আকাশটাও রিজার্ভ করতে পারে! যেখানে আমার দু’মুঠো ভাত জোগাতে বাব-দাদার নাম ভুলে যেতে হয়।
হিসাব-নিকাশ কষে যা পেলাম তা হলো এমন― ‘আমার হেলিকপ্টার’, পিছনে তক্তা বাঁধা সাইকেল! প্যাডেল মেরে চালাতে হয়। পাইলট বলতে লুঙ্গি পরা―স্যারের ছোট ভাই! আর তাদের বিমান এয়ারপোর্ট থেকে রিজার্ভ করে, সাদা পোশাক পরা ইংলিশে কথা বলতে বলতে রানওয়ে থেকে দৌঁড়ে নিয়ে আকাশে ওড়ে…!
Add Comment