গল্প

হ্যাপি নিউ ইয়ার

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-শাহিদা ইসলাম

রইসুল ইসলাম সবাই আদর করে ডাকে রসু, বাবা রফিকুল ইসলাম, পেশায় ব্যারিস্টার, মা মমতা, পেশায় শিক্ষক। মায়ের একটি মাত্র সন্তান, নাড়ি ছেড়া ধন। আজ ১৯ বছর পর দেশে আসছে। ফজর নামাজ পরেই বাবা বাজারে ছুটলেন, ছেলের পছন্দের খাবার আজ রান্না হবে।

খোকার মা আমি বাজারে চললাম, তুমি এদিকে সব সাজগোজ কর। মালি বেচারা ফুল বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, ছোট সাহেব আসছেন। উনার পছন্দের বাগান, একটি মরা পাতা পেলে খোকা রেগে যাবে।

প্রকৃতির সবুজ শ্যামল ছায়া রসুর প্রিয়। বিদেশে নাকি গাছের জন্য রাস্তার নকশা চেঞ্জ হয়ে যায়।আর এদেশে রাস্তা বানাতে যদি গাছ কাটতে হয় সহজেই তা কেটে ফেলে।

মায়ের আজ খুশির অন্ত নাই।এক তলা থেকে তিন তলা আজ পায়ে হেঁটেই উঠা নামা করছেন।রসু বাড়িতে আসবে, আমার প্রাণ পাখি আমার কলিজার টুকরো আমার মানিক সোনা,মমতা নানা ভাষায় ছেলের আসার আনন্দ প্রকাশ করছে। বাবুর্চি মিয়ার আজ ছুটি, আজ মায়ের হাতের রান্না খাবে তৃপ্তি সহকারে।

বাজারে ব্যারিস্টার সাহেবকে দেখে একজন ল ইয়ার দাঁড়িয়ে গেল,সালাম দিয়ে জানতে চাইল, আপনাকে কোন দিন এই বাজারে আসতে দেখি নাই।আজ কি মনে করে? বাজার করার মাঝে একটা আনন্দ আছে এটা রফিক সাহেব জানেন, কিন্তু সময় সুযোগ, ইচ্ছা কোনটাই হয় না।দুজনের জন্য কাজের মানুষ ৬ জন। এত লোক থাকতে উনার বাজারে আসার প্রয়োজন কি? এই লোক জন সব সরকার থেকে বরাদ্দ।

বড় মাছের কাছে গিয়ে থেমে গেল, চিতল মাছের কোপ্তা, আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি, রুই মাছের ফ্রাই আর ইলিশ মাছে সরিষা দিয়ে রান্না।এই সব রসুর প্রিয় খাবার। বাজার করে বাড়ি ফিরেই এমন হাক ডাক যেন ডাকাত পরেছে।

কই গো মমতাময়ী, উনি এই নামেই ডাকেন।
শোন খোকার পছন্দের সব মাছ কিনে এনেছি, তুমি নিজেই সব রান্না করবে, আহা নারিকেল আনতে ভুলে গেছি, মালাইকারি তে দিতে হবে! মমতা আশ্বাস দিলেন আরে চিন্তা নেই ঘরেই নারিকেল আছে। রফিক সাহেব গোসল সেরে নাস্তার টেবিলে এলেন, তাড়াতাড়ি খাবার দাও খেয়েই ছুটতে হবে।

মমতাময়ী খুব অসন্তুষ্ট হলেন,এত দিন বাদে আমাদের একমাত্র পুত্র আসছে, আর তুমি দেখ আমিও আজ স্কুলে যাব না। তোমার স্কুল আর আমার কোর্ট কি এক হলো? আমার দায়িত্ব দেশ পরিচালনা করা দেশের খারাপ মানুষের আচার বিচার আমাকে দেখতে হয়, জেরা করতে হয়, পক্ষ বিপক্ষের কথা শুনতে হয়। এই নিয়ে লড়তে হয়।

এই পেশায় আমি আছি আমার ছেলে কেও তাই বানালাম, মমতাময়ী তুমি তো গর্বিত বধু, গর্বিত মা। তোমার তো গর্ব করা উচিত। তোমার ছেলের জন্য শুভ কামনা কর, যেন দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়। এই দেশে অনেক মানুষ আছে যারা বিনা বিচারে জেল হাজত খাটে। একজন ল, ইয়ার ঠিক করে আইনী লড়াই করতে পারে না।অর্থ কষ্টের জন্য। উনি নাকেমুখে কিছু দিয়েই গাড়িতে উঠে বসলেন।

মমতাময়ী কিছু বলার আগেই গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। আজ একটা নয় দুটো বিশেষ দিন।মমতাময়ী এই দিনে প্রথম মা হয়েছিলেন। পরেরটি আজ ৩১ ডিসেম্বর।

বাড়িতে আলোকসজ্জা র ব্যবস্থা হচ্ছে নিচে ডেকোরেশন কাজ চলছে। সিঁড়িতে তাজা ফুলের তোড়া লাগানো হচ্ছে, ছাদে এক পাশে বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে মাটির চুলা, আরেক পাশে বারবিকিউ, কয়লা কাঠের ব্যবস্থাও আছে।

মাটির চুলায় চিতই পিঠার আয়োজন হবে। ছেলের আগমনের বার্তা সারা শহরে ছড়িয়ে পরেছে, এর কারণ হচ্ছে ছেলে ব্যারিস্টার হয়ে আসছে এসেই বাবার প্রতিপক্ষ হয়েও কাজ করতে পারে, এই খবর সবার মুখে মুখে।

ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম এই শহরের নামকরা ব্যারিস্টার, সত এবং ন্যায় পরায়ণ মানুষ উনি।সবার চোখ থাকে উনার দিকে, কিন্তু উনি যে কোন কেস হাতে নেন না ঘটনার মাঝে সততা থাকলে তবেই হাতে নেন।

আতসবাজি কেনা হয়েছে। বাড়ির পাশের একটা প্লটে রহিমার মা থাকে, পেশায় দর্জি, রহিমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, এদেশে ন্যায়্য বিচার সে পায় নাই।যুদ্ধের অস্ত্র আনা নেয়া করত। খাবার সরবরাহ করত, কেউ আহত হলে সেবাযত্ন করতো।দেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ প্রাণের রক্তের বিনিময়ে। উনি আহতদের কাধে করে পদ্মার চর পাড়ি দিয়েছেন, মুক্তি বাহিনীর সাথে পাক হানাদের গুলি পাল্টা গুলিতে আহত হন, বাম পায়ে গুলি লাগে। জংগলের ভিতর বসে নিশব্দে গুলি টেনে বের করেন। রক্তে মাটি ভিজে বাংলাদেশের পতাকায় রূপ নেয়, ঘাস পাতা ছিড়ে ক্ষত জায়গায় লাগিয়ে গায়ের গেঞ্জি ছিড়ে ব্যান্ডেজ করেন।

এই মানুষটি মুক্তি যোদ্ধার খেতাব পান নাই।এলাকার সনদ, চেয়ারম্যান সাটিফিকেট সব কাগজ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে জমা দিলে তা কার্যকর হয় না। রফিক সাহেব মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, সব কাগজ দেখে যাচাই বাছাই না করেই বলে দিলেন আপনি কিসের মুক্তিযোদ্ধা? কোথায় যুদ্ধ করেছেন? উনি বিস্তারিত জানালেন,আমি বরিশালে যুদ্ধাদের সহায়তা করেছি, সময়ে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছি।

আপনি ভারতে গিয়েছিলেন? না তাহলে আপনি মুক্তিযোদ্ধা না, এই কথা শোনার পর নিজের মাথার চুল ছিড়তে শুরু করলেন।সব কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে মন্ত্রির রুম থেকে বেড়িয়ে এলেন। তার অভাবের সংসার, বয়সের চেয়েও বেশি বয়সের ভারে নুইয়ে গেছে।

কেউ যদি জানতে চায় আপনি ভাতা পান কিনা সরকার থেকে? খুব ক্ষেপে যায়,কেন সরকার আমাকে টাকা দেবে? আমি কে? দেশের জন্য আমার অবদান কতটুকু? আমি একজন সাধারণ মানুষ, হাত পা আছে কাজ করে খাব।

এই বাড়ির ভাল মন্দ খাবারের অংশিদার তাঁরা।
রহিমার বিয়ে হয়েছিল এক আদম বেপারীর সাথে, বিদেশে অবৈধ নারী পাচার কালে ধরা পরে এখন জেলের ঘানি টানছে।

বাবার সংসারে বোঝা হয়ে চলছে।দুই সন্তান নিয়ে মোট চারজন।মা সেলাই কাজ করেন,অবসরে আরবি পড়ান, ব্যারিস্টার সাহেব আপন রক্তের কেউ না হলেও কিছু কম নয়,গ্রামের মানুষ হিসাবে।

ছেলে আসবে লন্ডন থেকে,ছোট বেলায় মমতাময়ী তাঁর খালার বাড়ি লন্ডনে তাকে রেখে আসেন,যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য।

খালু লন্ডনের বাংলাদেশ হাউজে জব করেন।
এর মাঝে মা বাবা গিয়ে ছেলেকে দেখে এসেছে।

রফিক সাহেব অফিস শেষ করেই সোজা গাড়ি নিয়ে এলেন শাহবাগ ফুলের দোকানে, ছেলের জন্য বিশাল ফুলের তোড়া নিলেন,যদিও ছেলের পছন্দের ফুল এই সিজনে মেলা ভার,বেলি ফুলে সে তুষ্ট। ফুল গাড়িতে নিয়ে সোজা সোনারগা।কেকের অর্ডার দেয়া এখানেই।

বছরের শেষ দিন, কেকের উপর লেখার জন্য উনি কোন সিলিপ দিয়ে যান নাই। এরা নিজে থেকেই Happy new year লিখেছে। ১০ পাউন্ড কেকের উপর বিশাল করে লাল নীল অক্ষরে লিখা।

বাড়িতে আনার পর বেশ আনন্দ পরে গেল, এত বড় কেক, মমতা তোমার ছেলের জন্য দেখ কি এনেছি, বলেই কেক, ফুল আর একটা বক্স হাতে দিলেন। খোকা কি একা আমার ছেলে?

রাত আট্টায় ছেলের ফ্লাইট, বাবা গাড়ি পাঠিয়েছেন, ফোনে কথা হয়ে আছে এমন্টাই।

মায়ের হাতে কোন কাজ সহজে উঠছে না, বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে, ছেলে আসার উত্তেজনায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামায় বিঘ্ন ঘটছে। পা ফস্কে গেছে কয়েকবার। রফিক সাহেব কয়েকবার হাত ধরে বসিয়েছেন, আরে একটু বস, রেষ্ট কর, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে স্কুলে পরিক্ষার রুমে গার্ড দিচ্ছো।

রহিমার দুই ছেলে জেগে আছে আতশবাজি দেখবে , আতশবাজি অনেক দাম। মায়ের শখ ছেলে এসে মুগ্ধ হবে। রইসুল ইসলাম যথা সময়ে বাড়িতে এলো। গেটের থেকে ছেলেকে বরণ করলেন বাবা,মায়ের চোখে জল ছলছল।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা ভেতরে এলেন।মায়ের রুমে ঢুকে ছেলে দৌড়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।মাগো তুমি কেমন আছো? একি মা তোমার চোখে পানি! আরে না বোকা ছেলে এটা আনন্দ অশ্রু।

রাত ১২ টার আগেই খাওয়া কমপ্লিট করে অপেক্ষায় রইল কখন বাজবে সেই ঘন্টা, মা বলল বাবা কেকটা কেটে নে তোর জন্মদিন কিন্তু পার হয়ে যাবে ১২ টার পর। মা ইংলিশ নিয়ম মেনে কেক কাটার দরকার নেই। আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাবো ঠিক ১২ টা ১ মিনিটে।

চারিদিকে ফটাস ফটাস করে বোম আতশবাজি শুরু হলো।কেকের বক্স থেকে কেক বের হলো।
মা চিতকার করে উঠলো, একি তুমি খোকার জন্মদিনের কেক বানাতে দাও নাই? এটা কি? বাবা বাড়িতে এসে বলার সুযোগ পায় নাই।

ছেলে বুঝিয়ে শান্ত করল।কেক কাটা হলো।
এবার মা বলছে বাবা তোমার পছন্দের ফুল পাই নাই, তবে আমার পছন্দের গোলাপ এনেছে তোমার বাবা, ফুলের তোড়া বুকে জড়িয়ে ছেলে খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে গেল।

হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজে বম ফুটল,মা বাবা কেঁপে উঠল, রসু খুব বিরক্তের সুরে বলল, এই বম আতশবাজি আমার পছন্দের বাইরে।
কারণ কত অভাবী লোক আছেন, যারা এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে থাকে।

যেই দেশে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় বাবা মা মারা যায়। সেই দেশে আগুনের ফুল্কি দেখে অর্থ নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। মায়ের মুখ কালো হয়ে গেল। ছেলের জন্য ৫০ হাজার টাকার আতশবাজি কিনেছেন।
কত মানুষ অসুস্থ, হার্টের পেসেন্ট, এই শব্দে তাদের ক্ষতি হবে। নবজাতক শিশুর জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। জেনেশুনে কেন বিষ পান করব।

সাহস করে বলে ফেললেন, শোন বাবা শখের তোলা আশি টাকা। আমি তোমার জন্য অল্প কিনেছি, রহিম ভাইয়ের নাতিরা দেখার জন্য রাত জেগে এই শীতের মধ্যে বসে আছে।

মায়ের মুখ রক্ষার খাতিরে একটা বাজিতে আগুন ধরিয়ে আকাশে ছুড়ে দিল। বাকি আতশ বাজারে ফেরত দিয়ে , গরিবের শীত বস্ত্র কেনা হবে।

ঘুমাতে গিয়ে বাবা মায়ের একটাই আলাপ, ছেলে যোগ্য শিক্ষায় লালিত পালিত হয়েছে। মায়ের বুকটা গর্বে ভরে গেল। বাবা ছেলে দুজনার প্রফেশন এক হলো এই কথা বলে দুজনাই হো হো হাহা করে হেসে উঠল।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930