সাময়িকী : শুক্র ও শনিবার
– সম্রাট (মৌলিক)
একটু আগেই ফোনে কথা হল। রেবতীদি ফোন করেছিল অংশুকে।
– হ্যালো অংশু
– হ্যা দিদি, বল
– আগামী চারদিন তুই কি ভাবে এনগেজড?
রেবতীদি উঁচু ঘরানার মানুষ, সন্দেহ নেই। তবে যে সন্দেহটা অংশুকে মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত করে, তা হল ওর অতি বিনয়। অংশুর মত মানুষকে এতটা পাত্তা দেওয়ার কি প্রয়োজন আছে ও বোঝে না।
– আগামী চারদিন কেন, চার বছরেও কোন এনগেজমেন্ট নেই। না হলে এত দিনেও সিঙ্গেল?
– চুপ কর ফাজিল। তোর ওই সবুজ বস্তা গুছিয়ে নে। কাল ভোর পাঁচটায় মোহন সুইটসের সামনে অপেক্ষা করবি
– ঠিক আছে
– জানতে চাইবি না কোথায় যাবি, কাদের সাথে যাবি, কেন যাবি?
– গাড়িতে বসে জেনে নেব
– ফাজিল ছোকরা। রাখলাম
সবুজ বস্তা বলতে ওর ঘষে যাওয়া একটা ন্যাপস্যাক। বছর দশেক বয়স হয়েছে। প্রথমে যত কিছু বইতে পারত এখন পারে না। একটা করে বছর ফুরিয়েছে আর অংশুর প্রয়োজন কমেছে। তাই ন্যাপস্যাক বৃদ্ধ হলেও অংশুর আকাঙ্ক্ষার চাপ ওকে বইতে হয় না। ন্যাপস্যাকের দুশ্চিন্তা ছিল। ও রিটায়ার করলে কি হবে? কারণ বহনকারীদের কোন বৃদ্ধাশ্রম হয় না।
আজকাল বেশিরভাগ ফোনালাপ শেষ হয় ‘রাখলাম’ বা ‘চল’ শব্দ দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে কি ‘রেখে দিচ্ছে’? ‘রাখলাম’ বলবার ধরণগুলোও আলাদা আলাদা। কোনটা অনুরোধ, কোনটা সম্মতি আদায়, কোন ‘রাখলাম’ সব সম্পর্ক শেষ করে স্মৃতি রেখে দেওয়ার শেষ ঘোষণা। ‘রাখলাম’ শব্দটা একটা স্থির শব্দ। মনে হয় ফোনের এপার ওপার জুড়ে বলা শব্দগুলো শতাব্দী জুড়ে রাখা থাকবে। শব্দের মিউজিয়ামে।
এর ঠিক উল্টো পিঠে রয়েছে ‘চল’। এ আবার একটা দুরন্ত শব্দ। এগোতে চায়, দৌড়োতে যায়। ভ্রমন রসিক শব্দ। কিন্তু
‘চল’ বললে কোথায় চলে যেতে হয়? সেই চলা কি একসাথে হবে? নাকি বুঝিয়ে দেওয়া, এবার তুমি বাকি পথটুকু একাই শেষ করে নিও। বাবা মা কখনো সন্তানকে ‘চল’ বলে ফোনকল শেষ করে না। কেন করে না? যার চোখ, যার হাসি ঝর্ণার মত মন ভিজিয়ে দেয়, তাকে কিশোর প্রেমিক কথার শেষে ‘চল’ বলে কল কাটে না। কেন?
এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন স্কলার রিসার্চ করেন না। অথচ খুব জরুরি। ফোন কলের শুরু অথবা মাঝের সময় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা একদম শেষের কথাগুলো। কিন্তু গোটা মানবজাতি এমন প্রগাঢ় বিষয়কে বরাবর তুচ্ছ করে এসেছে। অংশু ভাবছে ওকেই কিছু একটা করতে হবে। ইউরোপের জার্নালে ওর রিসার্চ পেপার ছাপা হলে ওকে আর মোহন সুইটসের সামনে দাঁড়াতে হবে না। ধবধবে সাদা ইউনিফর্মের সফার ওর বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়বে। অবশ্য সেই ড্রাইভার সাহেব খুব অবাক হবে। কারন ওই পোশাকের ড্রাইভার ফোনে অথবা কলিং বেলে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। এই কলিং বেল ভাবতেই অংশুর মনে পড়ল স্যার গ্রাহাম বেলের কথা। ওনার বান্ধবীর নাম ‘হ্যালো’। উনি বান্ধবীকে প্রেমসূচক গলার স্বরে বলেছিলেন ‘হ্যালো’। বাকিটুকু কোথাও লেখা থাকে না। অংশু এত দিন বিশ্বাস করত গ্রাহাম স্যার হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক বিজ্ঞানী। না হলে অত বড় আবিষ্কারের পর প্রথম ফোন ‘পরে পাওয়া’ সম্পর্কের কোন মানবীকে করেন? তবে আজ অন্যকিছু মনে আসছে। সিনেমার স্ক্রিপ্টের মত।
এখনের মত সেদিনও যথারীতি ওনার বলা প্রথম শব্দটাই বিখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু ফোন কল কেটে দেওয়ার আগে ওনার শেষ শব্দ কি ছিল? এমনও তো হতে পারে, উনি বললেন,
-হ্যালো
-ডার্লিং
-হ্যালো আমি পেরেছি শেষ পর্যন্ত
হ্যালো আনন্দে চোখের জল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সামাল দিতে দিতে বলল
– গ্রাহাম, আমি জানতাম তুমি পারবে
– আমার একটা কথা আছে
– বল গ্রাহাম
– এখন আমার সামনে অনেক কাজ। অনেক দায়িত্ব। তুমি জীবনে একাই চলতে থাকো। কোনদিন ইচ্ছে হলে ফোন করে নিও। তারে বাঁধা জাদু এই কারণেই আমি আবিষ্কার করেছি
– কিন্তু গ্রাহাম তোমার আমার বন্ধন যে অদৃশ্য তারের মোচড়ে বাঁধা। সে যে আর থাকবে না
স্যার গ্রাহাম, চোখ নামিয়ে চিবুক শক্ত করে বললেন
– রাখলাম
অংশুকে কথায় কথায় ফাজিল বলার অভ্যাস আজ বহু বছর হল রেবতীদি রপ্ত করেছে। বেশ মিষ্টি করে বলে। ‘ফা’ তে জোর বেশি দেয়। অংশুর খুব ভালো লাগে। কেন লাগে সেটা ভেবে দেখা হয়নি। আজকে এত রাতে, লহমার সাথে ফাজলামি করতে ইচ্ছে করল।
রাত প্রায় আড়াইটা। লহমার ফোন কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিষ্টি করে গীতা দত্ত ভোমরাকে নাদান বলছেন। কলার টিউন পুরো শেষ হল না। কলারকে বঞ্চিত করে ওপারে লহমা চমকে যাওয়া স্বরে বলল
– অংশু? কি হয়েছে? এত রাতে?
– চল?
– কোথায় যাবো? এত রাতে তোমার সঙ্গে?
– রাখলাম
ফোন কল ডিসকানেক্ট করে হ্যান্ডসেট বন্ধ করে দিল। এখন থেকে আগামী চারদিন লহমা অংশুকে আর পাবে না। ফিরে এসেই দেখা করবে। বেচারি এ কদিন দুঃখ পাবে, আতঙ্কে থাকবে, কাঁদবে। তবু অংশুকে মানব জাতির স্বার্থে এই এক্সপেরিমেন্ট করতেই হবে। ‘রাখলাম’ আর ‘চল’ বলে শেষ করা ফোন কলের ডাইমেনশন খুঁজে বার করতেই হবে।
লহমা হয়ত অভিমানে আরও নরম হবে। ভিজে যাবে। সেই মুহূর্তে লহমাকে ও বলবে, গ্রাহাম স্যারের মত লহমাকে ছেড়ে যায়নি। যাবেও না। অংশু লহমাকে ওর বুকের ভিতরে নিরাপদে রেখে আজীবন চলতে থাকবে।
হাঁটতে থাকবে তোমাদের এই শহর ছেড়ে অনেক দূরের পাহাড় ঘেরা উপত্যকার জন্য। যেখানে কোন পুরুষ ‘হ্যালো’ বলে না। বলে ‘লহমা’
Add Comment