আমাদের চাঁদপুর অঞ্চলের ভাষায় ঢেহি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। তবে এর আভিধানিক নাম ঢেঁকি। ধান ডাল ইত্যাদি শস্য বা অন্যান্য বস্তু ভানবার বা কুটবার জন্য ব্যবহৃত এবং বড় কাঠের দণ্ড দিয়ে তৈরী যন্ত্রবিশেষ। ঢেঁকি [denki] n a kind of husking pedal operated in a seesaw manner. গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ ছিল ঢেঁকি।
আমাদের শাশ্বত কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জনপদে খুবই দরকারী ছিল এটি। তখন গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল । প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে ধান বানা ও চালের গুড়া কিংবা চিড়া কোটার জন্য ঢেঁকির ব্যবহার হত। ঢেঁকিছাটা চাউলের কদর ছিল খুব। এ চাউলের ভাতের মজাই আলাদা। ঢেঁকিছাটা চাউলে প্রচুর পরিমান ভিটামিন বিদ্যমান বলে এই চালের চাহিদা আজও কমেনি। অনেকেই খুঁজে খুঁজে ঢেঁকিছাটা চাউল সংগ্রহ করে। আমরা শিশুবেলায় দেখেছি, সারারাত জেগে আমাদের মা-চাচিরা ঢেঁকিতে ধান কুটত। তাদের সাথে রোজ হিসেবে নিত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের নারী কর্মীদের। নবান্নের সময় পিঠার জন্য চাউলের গুড়ি করত বেশ আনন্দ নিয়ে। সারারাত গান গেয়ে বাড়ির প্রায় সব নারী মিলে একজন আরেকজনের চাউল গুড়ি করে দিত। অনেক সময় আমরাও বায়না ধরতাম ঢেঁকিতে মা-চাচিদের মতো চাউল বা ধান কুটতে। বাংলার গ্রামীন সমাজে এই নিয়ে গানও রয়েছে। ‘ও ধান বানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া, আমি নাচি, তুমি নাচ হেলিয়া দুলিয়া। ও ধান বানিরে…… ধান বেচিয়া কিনমু শাড়ী পিন্দিয়া যাইমু বাপর বাড়ি, স্বামী যাইয়া লইয়া আইব গরুর গাড়ি দিয়া ।
ও ধান বানিরে…।’ চিরায়ত বাংলার এই গান বাঙালির ঢেঁকির আবহ ও নবান্নের কথা জানান দেয়। ঢেঁকিতে বারা ভানা নিয়ে প্রবচনও রয়েছে… ‘‘চিরা কুটি, বারা বানি, হতিনে করইন কানাকানি। জামাই আইলে ধরইন বেশ, হড়ির জ্বালায় পরান শেষ।” ঢেঁকি নিয়ে একটি জনপ্রিয় প্রবাদও আছে। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। যার ভাগ্য মন্দ তার কোনো অবস্হাতেই ভালো কিছু হতে পারে না। মর্মজ্বালায় ছটফট করা বুঝাতে বলা হয় ‘বুকে ঢেঁকির পাড় পড়া’ । আবার তাচ্ছিল্ল, খেদোক্তি কিংবা অকর্মা বুঝাতে বলা হয়ে থাকে, ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’। বোকা লোক বলতে বলা হয়, ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’। এছাড়া ঢেঁকি নিয়ে আমাদের গ্রামীন সমাজে নানা কথা-রূপকথা-উপকথা প্রচলিত। এখন ঢেকির ব্যবহার খুব একটা চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে ঢেকির ব্যবহার।
লেখক: হুমায়ূন কবীর ঢালী
Add Comment