-মিলন মাহমুদ রবি
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বা মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা ( জন্ম: ১৭৩২ – মৃত্যু: ১৭৫৭) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। পলাশীর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়।
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খান-এর কাছ থেকে ২২ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা অর্জন করেন। তার সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে।
জন্ম ও বংশপরিচয়
সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭৩৩ সালে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলীবর্দী খানের কোন পুত্র ছিল না। তাঁর ছিল তিন কন্যা। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড়ভাই “হাজি আহমদ”-এর তিন পুত্র, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে এবং জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগম-এর বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ-উদ-দৌলা) এবং মির্জা মেহেদী। আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তাঁর তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ-উদ-দৌলা)-এর জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের, যেহেতু তার কোনো পুত্র ছিলনা। তিনি মাতামহের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকেন। সিরাজ-উদ-দৌলার জন্মতারিখ বা সাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মীরজাফর তার কোন আত্মীয়ের মাঝে পড়েন না। কাজী ইসা তার চাচা হন।
যৌবরাজ্যাভিষেক
১৭৪৬ সালে আলিবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ তার সাথী হন। আলিবর্দী খাঁ সিরাজ-উদ-দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর বয়স অল্প ছিল বলে রাজা জানকীরামকে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু বিষয়টি সিরাজদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তিনি সোজা পাটনা গিয়ে উপস্থিত হন এবং জানকীরামকে তাঁর শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু নবাবের বিনা অনুমতিতে জানকীরাম তাঁর শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান। অন্যদিকে জানকীরামের আচরণে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে সিরাজদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে লড়াই শুরু হয়ে গেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলিবর্দী খাঁ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিনই আলিবর্দী খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন,
আমার পরে সিরাজ-উদ-দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে।
ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজ-উদ-দৌলার যৌবরাজ্যাভিষেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই সময়ে সিরাজ-উদ-দৌলার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। তবে তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তাঁর আত্নীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই তাঁর বিরোধিতা শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলিবর্দী খাঁর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেশ মোহাম্মদ। এছাড়া আলিবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজ-উদ-দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সিংহাসনে আরোহণ, নবাব সিরাজের মুর্তি, পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র ও নদীয়া
মুর্শিদকুলী খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ পর্যন্ত সুবাহ বাংলার নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা শাসন করছিলেন। তাঁর সময়ে তাঁর পুত্র সরফরাজ খান ১৭৩৪ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত ঢাকার নায়েব নাজিম এবং ১৭৩৯ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় (১৭৩৯-১৭৪০) ঢাকার নায়েব নাজিম হন আবুল ফাত্তাহ খান। প্রসঙ্গত, ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের সময় থেকেই নবাবগণ মুর্শিদাবাদে অবস্থান করতেন আর বাংলাদেশের জন্য তখন থেকেই একজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হতো। ১৭৪০ থেকে ১৭৪৪ পর্যন্ত আলীবর্দী খানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। তবে তিনি মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তাঁর সহকারী হোসেন কুলী খান এবং হোসাইন কুলীর সহকারী হোসেন উদ্দিন খানকে (১৭৪৪-১৭৫৪) ঢাকায় দায়িত্ব পালন করান। এ সময় থেকেই আলীবর্দীর ভ্রাতুষ্পুত্র শওকত্জংগ নওয়াজিস মুহাম্মদের বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধের জের হিসেবে ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খান এবং মুর্শিদাবাদে তদীয় চাচা নিহত হন। ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খানকে হত্যায় জড়িত ছিলেন আগা সাদেক এবং আগা বাখের। আগা বাখের ছিলেন বাখরগঞ্জের জমিদার এবং তাঁর পুত্র আগা সাদেক। হোসেন উদ্দিন খানের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগা সাদেক মুর্শিদাবাদে হোসেন কুলী খান কর্তৃক বন্দী হন। সেখান থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসে তিনি হোসেন কুলী খানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। অত্যন্ত সৎ এবং ধার্মিক হোসেন কুলী খানকে রাতের আঁধারে তাঁর প্রাসাদে প্রবেশ করে হত্যা করা হয়। সকাল বেলা ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে শহরের একত্রিত অধিবাসীগণ মারমুখী হয়ে ওঠে এবং আগা বাখের ও তদীয় পুত্রকে আক্রমণ করে। তারা নায়েব নাজিমের পদে নিয়োগের বিষয় বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করলে লোকেরা নায়েব নাজিম পদে নিয়োগের সনদ প্রদর্শনের দাবি করে। তা প্রদর্শন না করে তারা তরবারি ধারণ করে। এ অবস্থায় জনতার আক্রমণে আগা বাখের প্রাণ হারায় এবং আগা সাদেক মারাত্মকভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও পলায়ন করতে সক্ষম হয়। নোয়াজেশের পরমবন্ধু ছিলেন হোসেন কুলি খাঁ ও রাজবল্লভ। হোসেন কুলি খাঁ ছিলেন নোয়াজেশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে। তাঁর হত্যাকান্ডে রাজবল্লভ কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন। তখন তিনি অন্য ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করেন। নোয়াজেশ নিঃসন্তান ছিলেন বলে তিনি সিরাজের ছোটভাই মির্জা মেহেদীকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন। মির্জা মেহেদী নোয়াজেশের জীবদ্দশাতেই মারা যান। কিন্তু তাঁর অল্পবয়স্ক পুত্র সন্তান ছিল। রাজবল্লভ তাকেই সিংহাসনে বসিয়ে ঘসেটি বেগমের নামে স্বয়ং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি করার স্বপ্ন দেখছিলেন। এইরকম দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেই আলিবর্দি খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
চারদিকে শুরু হয় প্রচন্ড অরাজকতা এবং ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় দুর্গ সংস্কার করা শুরু করে। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠান। এ রকম পরিস্থিতিতেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর (সিরাজ-উদ-দৌলা) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
নবাব হিসেবে প্রাথমিক কার্যাবলি, মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার ও কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ
সিরাজ-উদ-দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন থেকেই কলকাতায় ইংরেজদের প্রতাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তিনি তাদেরকে দমন করার জন্য কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরণের কাজ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁর আদেশ না মেনে কাজ বহাল রাখলেন। সিরাজ-উদ-দৌলা তখন বুঝতে পারলেন গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে। সুতরাং প্রথমেই ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মতিঝিল অধিকার করে নবাব কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ মে তাঁর সেনাবাহিনী কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ করেন। তিনি কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে দরবারে হাজির হয়ে তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বলেন। ওয়াটসন এই অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য হন।
কলকাতা আক্রমণ
একই বছর ১৮ জুন সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দুর্গ সিরাজের দখলে আসে। তিনি দুর্গ প্রবেশ করে এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন। সে বছর ১২ জুলাই তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
নবাবগঞ্জের যুদ্ধ
দিল্লীর বাদশা পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি সনদ পাঠালেন। শওকত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেন। ইংরেজরা এই সংবাদ পেয়ে গোপনে শওকত জঙ্গের সাথে মিত্রতার করার চেষ্টা করতে থাকে। অপরদিকে মাদ্রাজের ইংরেজ দরবার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠায়। সিরাজ-উদ-দৌলাও শওকত জঙ্গকে প্রতিরোধ করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয়পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে শওকত নিহত হন। সিরাজ-উদ-দৌলা মোহনলালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।
ক্লাইভ ও ওয়াটসন পলতায় পৌঁছেই কলকাতা অভিমুখে রওনা হন। প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা দুর্গ জয় করে নেন। এর আগে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায় এসে সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সিরাজ-উদ-দৌলা তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমণ করে। সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে শংকিত হয়ে পড়েন এবং এ কারণে ইংরেজদের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাই ইংরেজদের সকল দাবিতে রাজি হয়ে তিনি ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সন্ধি ‘আলিনগরের সন্ধি’ নামে পরিচিত। কিন্তু ইংরেজরা তাদের মতিগতির কোন পরিবর্তন করল না। মূলতঃ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ফরাসিদের সঙ্গে। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। আলিনগরের (কলকাতা) সন্ধির প্রতিশ্রুতি পালনে নবাবকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল।
কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া
সব ধরনের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর সিরাজ-উদ-দৌলা সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে গেলেন। স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে তাঁরা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্ত শুরু করলেন। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা খুব শীঘ্রই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এরপর তাঁর সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছালেন। আর নবাবকে পত্র লিখলেন-
আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশীতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন?
সিরাজউদ্দৌলা সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি উঠিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছামাত্রই স্ক্রাফটন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপন সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক গোপন থাকলো না। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার ব্যবস্থা নিলেন। ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেলেন।
পলাশীর যুদ্ধ
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাঁকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ইংরেজরা ‘লক্ষবাগ’ নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করল। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মিরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
মীরমদনের পতনের পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজবাহিনী কে আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন।
কিন্তু মীরজাফর আবারও বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফেরার নির্দেশ দেন। এই সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়।
তখন কোন উপায় না দেখে সিরাজদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। সিরাজদ্দৌলা তাঁর সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।
বন্দিত্ব এবং মৃত্যু
মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ে আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মীর কাশিমের সৈন্যবাহিনীকে খবর দেয়। এ সম্পর্কে ভিন্ন আরেকটি মত আছে যে এক ফকির এখানে নবাব কে দেখে চিনে ফেলে। উক্ত ফকির ইতঃপূর্বে নবাব কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে তার এক কান হারিয়েছিল। সেই ফকির নবাবের খবর জানিয়ে দেয়। তারা এসে সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) মীরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে তাঁর নানা নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাঁকে কবর দেয়া হয়।
পরিবারের পরিণতি
সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তাঁর চার বছর বয়সী শিশুকন্যাকে মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ঢাকায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সিরাজের পতনের পূর্ব পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর আর তাঁকে কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। এ সময় তাঁরা তাঁদের মা শরফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা, খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাসহ সবাইকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। ঢাকার বর্তমান কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা প্রাসাদে তাঁরা বেশ কিছুদিন বন্দি জীবন যাপন করার পর মীরনের নির্দেশে ঘষেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে নৌকায় করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেসা, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তাঁর শিশুকন্যা রক্ষা পান এবং পরবর্তীতে তাঁদেরকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ কোম্পানি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাঁদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজের মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর লুৎফুন্নেসা ১৭৯০ সালে ইন্তেকাল করেন।
সিরাজকে হত্যার পর মীর জাফর ও মীরন আমেনা এবং পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের কয়েকটি নিকৃষ্ট নৌকায় চড়িয়ে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে ও অবহেলার সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগরে পাঠিয়ে দেন। সিয়ারুল মুতাখখেরিনের লেখক গোলাম হোসাইন তাবাতাবাই লিখেছেন যে, সিরাজ পরিবারকে জাহাঙ্গীরনগর পাঠানোর কিছুদিন পর মীরন জাহাঙ্গীরনগরের শাসনকর্তা ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি যশরথ খানকে লিখিত নির্দেশ দেয়, যাতে তিনি দু’জন হতভাগ্য বয়স্কা মহিলাকে (ঘষেটি বেগম ও আমিনা) হত্যা করেন। এই সদাশয় শাসনকর্তা এই মহিলাদের ও তাঁদের স্বামীদের নিকট তাঁর উন্নতি ও অন্নের জন্য ঋণী ছিলেন। তিনি মীরনের এই ঘৃণ্য নির্দেশ পালন করতে অসম্মতি জানান। পরে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে সিরাজের মা আমেনা এবং খালা ঘষেটি বেগম দীর্ঘদিন বন্দী থাকার পর তাঁদেরও পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
তথ্য: উইকিপিডিয়া
আমাদের সাখে সংযুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন আর জানুন অজানা ইতিহাস।
Add Comment