ইতিহাস-ঐতিহ্য

‘মীর জাফর’ এই নামটি এখনও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর

হ্যালোডেস্ক

‘মীর জাফর’ এই নামটি বাংলার মানুষের কাছে এখন একটি গালি, বেইমানের প্রতিশব্দ। কোন বাঙালিই আর তার সন্তানের নাম এটা রাখে না। যার কারনে এই নামটি গালিতে রূপ নিয়েছে, বেইমানের প্রতিশব্দ হয়েছে তার পুরো নাম ছিল মীর জাফর আলী খান। জন্মেছিল ১৬৯১ সালে। ইংরেজরা এই উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে একটা প্রধান হাত ছিলো সে। নদীয়ার পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত এবং নিহত হন। মীর জাফর সেই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিল। তার নিয়ন্ত্রনে থাকা সৈন্যদল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করায় নবাব সিরাজ-উদ দৌলা যুদ্ধে হেরে যান। এই ব্যাপার গুলো আমাদের জানা অনেক আগে থেকেই।

এই মীর জাফর ছিলো ইরানি বংশোদ্ভূত। তার পীতার নাম সৈয়দ আহমেদ নাজাফি। ছিল বাবা-মা র দ্বিতীয় সন্তান। পারস্য থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে তিনি বাংলায় আসে ভাগ্যান্বেষণে। এখানে এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকুরী শুরু করে।

১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে মীর জাফর আলীবর্দী খানের হয়ে নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে জয়লাভ করে আলীবর্দী খান। এই যুদ্ধে বেশ খ্যাতি লাভ করে সে। এই যুদ্ধের পরে আলীবর্দী নবাব হলে মীর জাফরকে মসনবদার পদ প্রদান করেন এবং নিজের বোন শাহ খানুমকে তার সাথে বিয়ে দেন। সেই সময় তার বেতন হয় ১০০ টাকা। এর পরে সে নবাবের সেনা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়।

সংগৃহীত ছবি

১৭৪১ সালের দিকে মারাঠারা বারবার বাংলায় আক্রমন করে এর ধন সম্পদ লুট শুরু করে। এদের দমনের জন্য নবাব আলীবর্দী খানকে বিরামহীন ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল। সেই সময় মীর জাফর এসব যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এবং সেনানায়ক হিসেবে বিশেষ কৃতিত্ব দেখায়। ১৭৪১ সালের ডিসেম্বরের দিকে মীর জাফর মারাঠাদের পরাজিত করে উড়িষ্যার বড়বাটি দূর্গ দখল করে সেখানে স্বপরিবারে বন্দী থাকা নায়েব নাযিম (উড়িষ্যার নায়েব এবং আলিবর্দীর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা) এবং সৈয়দ আহমদ খানকে মুক্ত করে।

১৭৪৬ সালে মেদিনীপুরে মারাঠাদের সাথে এক বৃহৎ যুদ্ধে পুরো মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করে। আর এর জন্য নবাব তাকে উড়িষ্যার নায়েব নাযিম প্রদান করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধে জয় লাভ করে মীর জাফর ধিরে ধীরে উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভী হয়ে পড়ে। মেদিনীপুরের যুদ্ধে হেরে মীর হাবিব এবং জানুজী ভসলের নেতৃত্বে এক বিশাল মারাঠা বাহিনী উড়িষ্যা থেকে মেদিনিপুরের দিকে অগ্রসর হয়। এতে মীর জাফর প্রথমবারের মত ভয় পেয়ে পালিয়ে বর্ধমানে আশ্রয় নেন। তাকে সাহয্য করার জন্য নবাব আলীবর্দী সৈন্যসহ আতাউল্লাহ খানকে পাঠান। কিন্তু তারা মারাঠা সৈন্যকে আক্রমণ না করে বরং আলীবর্দী কে হত্যা করে তার রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাধ্য হয়ে নবাব নিজেই সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলে মীর জাফর নিজের কর্মের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে বরং নবাবের সাথে উদ্ধত আচরণ করে। নবাব তাকে সাথে সাথে পদচ্যুত করেন। অবশ্য পরবর্তীতে তাকে আবার পূর্বপদে বহাল করলেও ততদিনে মীর জাফর ডুবে গিয়েছিল দুর্নীতি, লোভের অতলে। ১৭৫০ সালে মীর জাফর বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে ধরা পরলে, তার উপর নজর রাখার জন্য তার ভাই মির্জা ইসমাইলের পরিবর্তে খাজা আব্দুল হাদীকে সহকারী প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।

সেনাপতি হওয়ার পর মীর জাফর শুরুর দিকে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল শেষের দিকে এসে তা আর সে ধরে রাখতে পারেনি। বার্ধক্যজনিত কারণে নবাব অসুস্থ হয়ে গেলে মীর জাফর এবং রায় দুর্লভকে যুদ্ধে পাঠান। কিন্তু তারা অহেতুক সময়ক্ষেপ করতে থাকলে। বৃদ্ধ নবাব বাধ্য হয়েই আবার যুদ্ধে যান। যুদ্ধ বন্ধ করতে অবশেষে দশ বছর পর মারাঠাদের সাথে সন্ধী হলে তারা বাংলায় আক্রমন বন্ধ করে।

সংগৃহীত ছবি

ক্ষমতার লোভে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা যেমন সত্যি তেমনি অনেকের মতে মীর জাফরের মত জৈষ্ঠ, অভিজ্ঞ লোক থাকতে বালক অনভিজ্ঞ সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব করে ভুল করেছিলেন আলীবর্দী খান।

দীর্ঘদিন যুদ্ধ লড়ে একজন বালকের শাসন মানতে পারেনি মীর জাফর। যুদ্ধের পরে কোম্পানি মীর জাফরকে নবাবের মসনদে বসায়। কিন্তু ইংরেজদের সাথে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হলে তাকে সরিয়ে ইংরেজরা তার জামাতা মীর কাশিমকে নবাব বানায়। কিন্তু মীর কাশিম এই পরাধীনতা মেনে না নিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে। বক্সারের যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে ইংরেজরা মীর জাফরকে আবার মসনদে বসায়। ততদিনে মীর জাফর বুঝে গিয়েছিল ইংরেজদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার একটা আঙ্গুল নড়ানোর ও ক্ষমতা নেই। আর ইংরেজরাও বুঝে গিয়েছিল এই বাংলা লুটে নিতে চাইলে মীর জাফরের মত লোকই তাদের দরকার হবে। যে মীর জাফর শুরুর দিকে আলীবর্দী খানের সেনাপতি হয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, যুদ্ধে লড়েছিল সেই মীর জাফর ক্ষমতার লোভে আলীবর্দী খানের নাতি, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দেয়, বেঈমান বানিয়ে দেয় তার অন্যতম উদাহরণ এই মীর জাফর।

১৭৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে, নিমকহারামের চিরকলঙ্ক মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। মুর্শিদাবাদে তার বসবাসের বাড়িটিকে এখনো মানুষ নিমকহারাম দেউড়ী নামেই চেনে।

তথ্য: ইন্টারনেট

আমাদের সাথে সংযুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930