সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-সাফিয়া খন্দকার রেখা
হেমন্তের এই সময়টা নতুন চালের গন্ধে যেমন বাতাস ভারি হয় ঠিক তেমন ভারি হয়ে ওঠে প্রথমার মনের শরীর। কতগুলো বছর অথচ কিছুই মুছে যায়না ভেতর ভেতরে কি ভয়ঙ্কর চিৎকার! শরীর গুলিয়ে বমি আসতে চায়, বিছানা ছেড়ে অন্ধকার ঘরেই আস্তে আস্তে বেশিনের কলের কাছে এসে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। নিলয় গভীর ঘুমে থাকলেও পাশের ঘর থেকে শাশুড়ী মা ঠিক টের পেয়ে উঠে আসেন।
তুমি একজন ভালো ডাক্তার দেখাওতো বৌমা…
আজকাল প্রায়শই দেখি তোমার বমি হয় ঠিকঠাক ঘুম হয় না, নিশ্চয়ই আমার ছেলেটা ঘুমিয়ে থাকে কিছুই জানে না
কথাগুলো বলছেন আর প্রথমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন রওশন বেগম।
মা আপনি রাতে ঘুমান না একদম?
ঘুমিয়ে ছিলাম তোমার বমি করার শব্দ পেলাম,
স্যরি মা…
আরে স্যরি বলার কি আছে
তুমি কিন্ত অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবে কাল, আর আজকাল তো ঘরেই টেস্ট করার কি সব বের হয়েছে নিজেওতো করতে পারো।
প্রথমা জানে শাশুড়ী মা ধরেই নিয়েছেন অন্য কিছু,
কিন্ত ও তো জানে নভেম্বর এলেই ও কেন সিক হয়ে যায়,
দশটা বছর অথচ ক্ষতের উপরে এতোটুকুও প্রলেপ পড়েনি।
প্রথমার শরীরে কেমন শীত লাগছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর শরীরে পৌষের ঠান্ডার মতো কাঁপন শুরু হতে লাগলো, পায়ের কাছ থেকে কাথাটা টেনে নিজের শরীরে দিলেও শীত কমছে না, নিলয়কে ডাকছে কিন্ত কোন শব্দ বের হচ্ছেনা প্রথমার মনে হোল ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, নিলয়কে ডাকছে কতক্ষণ তারপর আর কিছু মনে নেই ওর…..
প্রথমার স্বামী নিলয় নিতান্তই ভদ্র এবং গো – বেচারা টাইপের মানুষ দশ বছর আগে যখন প্রথমাকে বিয়ে করে তখন সেই ঘটনা ছিলো একটি সিনেমার গল্পের মতো নিলয়ের বয়স তখন বিয়াল্লিশ আর প্রথমা মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষে একুশ কিংবা বাইশ বছরের এক সুন্দরী যাকে দেখলেই যে কোন যুবকের মাথা ঘুরে যায়। প্রথমার বাবার অফিসের কম্পিউটার অপারেটর নিলয়ের যাতায়াত ছিলো মোবিন সাহাবের বাড়িতে কারণ তার পি এর কাজও নিলয়কেই করতে হোত। মা ছোট বোন আর নিলয়কে নিয়ে তিন জনার সংসারে কোন বৌ নিয়ে আসতে পারেনি নিলয়ের মা শত চেষ্টা করেও কি এক অজ্ঞাত কারণে নিলয় বিয়ের নাম শুনতেই চাইতো না সেই মানুষ বিয়াল্লিশ বছর বয়সে যখন বসের মেয়েকে ঘরে এনে বললো মা দেখো আমি কিচ্ছু জানিনা কিভাবে কি হলো।
নিলয়ের মনে হয়েছে বাবার প্রতি প্রতিশোধ নিতে এই কাজ করেছে প্রথমা রাগ কমে গেলেই ও চলে যাবে কিন্ত নিলয়ের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দশ বছর এখনও একসাথে আছে ওরা।
নিলয়ের মনে আছে মোমিন সাহেব যেদিন মেরিনা আপুকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে গেলেন তার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই প্রথমার মা স্ট্রোক করে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মরে গেলেন প্রথমা একটুও কাঁদেনি সেদিন। মেরিনা মোমিন স্যারের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করেছে মাত্র আট মাস। খুব স্বাভাবিক ছিলো একুশ বছরের মেরিনাকে নিয়ে যখন ঘরে ঢুকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মোমিন সাহেব।
“এই যে তোমাদের ছোট মা,
তোমার মা অসুস্থ থাকেন বেশির ভাগ সময় এজন্যই তাকে নিয়ে এলাম আমার সেবা করবে, তোমাদের যত্ন নেবে”
তুলি বুলি জমজ দুই বোনের বয়স তখন তেরো ওরা দুজন দৌড়ে মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে কতক্ষণ সে দরজা বন্ধ ছিলো মনে নেই। প্রথমা মেরিনার কাছে এসে আস্তে করে প্রশ্ন করেছিলো
তোমার বয়স কতো ছোট মা?
সদ্য বিবাহিত লাল বেনারসি মোড়ানো মেয়েটি জবাব দিয়েছিলো একুশ…আমার বয়স কত জানেন ছোট মা?
মেরিনা মাথা নেড়ে না বলেছিলো,
আমি আপনার সিনিয়র আমার বাইশ
তারপর সব দ্রুত ঘটে গেলো
প্রথমার মায়ের মৃত্যুর তিন দিনের শেষে নিলয়েকে অফিসের ডেস্ক থেকে কাজী অফিসে নিয়ে গেলো প্রথমা।
তুলি বাসা থেকে বেড়িয়ে সেই যে কোথায় গেছে আজও কেউ জানেনা বুলি মেঝ মামার সংসারে থাকে সেই থেকে মামীর কোন সন্তান নেই ওকে বেশ আদোর করেই রেখেছেন তারা।
নিলয় জানে নভেম্বরের তিন তারিখ থেকে পুরোটা মাস প্রথমাকে এইসব ঘটনা বেশি করে জাপটে থাকে। পাঁচ বছর পড়ে এক সন্ধ্যায় নিলয় যখন জানালো মোমিন সাহেব অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হাসপাতালে অক্সিজেন দেয়া ডাক্তার বলেছেন অবস্থা ভালো না,
নিলয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রথমা বলেছিলো..
পাঁচ বছর আগের লাশের নতুন করে আবার কিসের মৃত্যু!!
মেরিনার ঘরে সাত বছরের এক ছেলে আছে মোমিন সাহেবের। বারবার ফোন করে সেই ছেলে প্রথমাকে কি আদুরে গলায় ডাকে… বড় বুবু
আমাকে দেখে যাও মা তোমাকে কিছু বলতে চায়। প্রথমা শুনতে পায় পাশে কেউ শিখিয়ে দিচ্ছে কথাগুলো,
প্রথমার কি যেনো হয় দশ বছর পর সে সেই বাড়িটার দিকে ছুটছে যেখানে তার বাইশটি বছর কেটেছে যেখানে তুলি হারিয়ে গেছে যে বাড়িতে মা মরে গেছে দশ বছর আগে প্রতিদিন অফিস ফেরত বাবার জন্য ওরা অপেক্ষা করতো তিন বোন বাবা গরম গরম নাস্তা নিয়ে ঘরে ফিরতো দূর থেকে প্রথমা বলে চিৎকার করতো…
বাড়ির অদূরে এসে প্রথমার পা চলতে চায়না, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো মনে নেই হঠাৎ প্রথমার মনে হোল দু পাশ থেকে দুটো হাত তাকে ধরে আছে, ছোট্ট একটা হাত টানছে চেনা ঘরটার দিকে.. আর বলছে তুমি বড় বুবু আমি তোমাকে চিনেছি,
প্রথমা তাকিয়ে দেখলো হুবহু বাবার ছেলে বেলার চেহারার একটা ছোট্ট হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে
মেরিনাকে বেস বয়স্ক লাগছে…
স্বামী মরে গেলে বুঝি মেয়েরা বয়সের আগেই বুড়িয়ে যায়!
মেরিনা একটি বড় খাম এনে প্রথমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই মামার ঘরে মানুষ হয়েছি মামা আপনার বাবার বন্ধু ছিলেন তিনিই চাকরি দিলেন বিয়ে দিলেন। আপনার বাবা আপনার কথা খুব বলতেন এই বাড়ি অফিসের টাকা পয়সা সব আপনার নামে করে দেয়া…
ছোট্ট হাতটা তখন প্রথমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করছে
বড় বুবু তুমি কি আমাদের তাড়িয়ে দেবে এ বাড়ি থেকে!
প্রথমা ফাইল না খুলেই মেরিনার হাতে দিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ছোট্ট হাতটা আবার টানছে..
প্রথমা মেরিনার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে আগামী সপ্তাহে উকিল নিয়ে আসবো সব ভাইয়ের নামে করে দেবো, মেরিনার কান্নার মুখটা একদম মায়ের মতো লাগছে আজ প্রথমার কাছে…
Add Comment