-ফরিদুল ইসলাম নির্জন
কুরআন পাকের ১৪৪১ বছর চলছে
ছোটবেলার বাঙলা বইয়ের একটি গদ্যাংশে পড়তাম ”আজ ঈদ মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে শিশুদের কলোরব। দলে দলে লোকজন ঈদগাহে যাচ্ছে। তাদের গায়ে নানান রংয়ের পোষাক। বাতাসে আঁতোরের গন্ধ…………..” গদ্যটির লাইন যেনো ঠোঁট প্রিন্টিং। হাদিসের উপর ভিত্তি করে একটি গদ্য সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মুল কাহিনীটি ছিলো সম্ভবত এমন। নবিজী হযরত মুহাম্মদ সাঃ যাচ্ছেন ঈদগাহ ময়দানে। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন পথে বসে কাঁদছে এতিম শিশু। নবীজী ছেলেটির মাথায় হাত রাখলেন, তাকে জিজ্ঞেস করলেন – কি হয়েছে খোকা কাঁদছো কেন? তারপরের কথা মনে নেই। তবে মনে আছে, নবীজী ছেলেটিকে নিয়ে যান বাসায় এবং নতুন জামা, কাপড় আর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই গদ্যটি জীবনের প্রথম পাঠ মহানবী (সঃ) কে নিয়ে লেখা। তারপর কতো জেনেছি, শুনেছি এই মহামানব সম্পর্কে। তার সম্পর্কে জানার শেষ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) হলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় মহামানব। একটা আবেগ ও বাস্তবের যায়গা। একটা ভালোবাসার যায়গা।
গ্রামের অনেক মানুষ বিড়ি খান। নামায পড়েন না কিন্তু মহানবী (সঃ) কে নিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু বললেই তার প্রতিবাদ করেন। মাথায় আঘাত করতে দ্বিধা করেন না।
মহনবী (সঃ) হলেন অনুভূতির কলিজা। এখানে আঘাত করলে মানুষ নীশ্চুপ থাকতে পারে না। কারো কলিজা টান মারলে কি সে ছেড়ে দেবে। ব্যাপারটি এমন। মহানবী (সঃ) কে নিয়ে অনেক অতি প্রগতিমনা উল্টা পাল্টা অনেক কিছুই বলেন। ব্যাপারটি এমন যে যতো বেশি বলবে সে যেনো ততো বড় প্রগতিশীল। আমি এমন অতি প্রগতিশীলদের চরমভাবে ঘৃণা করি। আপনার ভালো লাগে না এড়িয়ে যান। বাট অন্যর বিশ্বাসের কলিজায় আঘাত করতে চান কেনো? মহানবী (সঃ) কে নিয়ে অন্য ধর্মের মনীষীগন অনেক কথা বলেছেন।
স্যার জর্জ বার্নাড শ “ দ্য জেনুইন ইসলাম” বইয়ের ১ম খন্ডে লিখেছেন, মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর(মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি– চমৎকার একজন মানুষ এবং আমার মতে খ্রিস্টান বিরোধী হওয়া সত্বেও তাঁকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির নিকট যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সাথে সমাধান করতেন যা বহু প্রতিক্ষীত শান্তি ও সুখ আনয়ন করতো। আমি ভবিষ্যতবাণী করছি যে মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামীদিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতিমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে।
থমাস র্কালাইল “ হিরোস, হিরো এন্ড হিরো ওয়ারসপ এন্ড হিরোইক ইন হিস্ট্রি” বইতে লিখেছেন, এ লোকটিকে (মুহাম্মদ) ঘিরে যে মিথ্যাগুলো (পশ্চিমা অপবাদ) পূঞ্জীভূত হয়ে আছে- যার ভালো অর্থ হতে পারে ধর্মান্ধতা, তা আমাদের নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক।
মহাত্মা গান্ধী তার ইয়ং ইন্ডিয়া বইতে লিখেন, আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম যিনি আজ লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন…….যেকোন সময়ের চেয়ে আমি বেশী নিশ্চিত যে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেইসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা, তাঁর অটল সাহস, ভয়হীনতা, ঈশ্বর এবং তাঁর(নবীর) ওপর অর্পিত দায়িত্বে অসীম বিশ্বাস। এ সব-ই মুসলমানদেরকে সকল বাঁধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যখন আমি মুহাম্মদের জীবনীর ২য় খন্ড বন্ধ করলাম তখন আমি খুব দু:খিত ছিলাম যে এই মহান মানুষটি সম্পর্কে আমার পড়ার আর কিছু বাকি থাকলো না।’
পৃথিবী বিখ্যাত বই বিশ্বের একশ জন প্রভাবশালী বইয়ের লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার বইতে বলেন, মুহাম্মদকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থান দেয়াটা অনেক পাঠককে আশ্চর্যান্বিত করতে পারে এবং অন্যদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সেকুলার এবং ধর্মীয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ সফল ছিলেন। সম্ভবত ইসলামের ওপর মুহাম্মদের তুলনামূলক প্রভাব খ্রিস্টান ধর্মের ওপর যীশু ও সেইন্ট পলের সম্মিলিত প্রভাবের চেয়ে বেশী।…. আমি মনে করি, ধর্মীয় ও সেকুলার উভয়ক্ষেত্রে প্রভাবের এই বিরল সমন্বয় যোগ্য ব্যাক্তি হিসেবেই মুহাম্মদকে মানবেতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একেশ্বরবাদী এবং ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী। জীবনের অনেক সময় তিনি মুসলমানদের সঙ্গে এই বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। তার অজস্র রচনা বিশেষ করে কবিতা ও ছোটগল্পে মুসলমানদের প্রসঙ্গ বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ধর্মে ও কর্মে তিনি ছিলেন সর্বজনীন এবং মানবতাবাদী। তার সাহিত্যের সীমানা শুধু একটি বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তিনি ইসলাম ও ইসলাম ধর্মের ‘প্রফেট’ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২৬ নভেম্বর পবিত্র মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মুম্বাই শহরে একটি সমাবেশ হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মির্জা আলী আকবর খান। রবীন্দ্রনাথ এই সভায় একটি অপূর্ববাণী প্রেরণ করিছেলেন। সভায় তার প্রদত্ত বাণী পড়ে শুনিয়েছিলেন সরোজনী নাইডু। ১৯৩৪ সালে কলকাতা বেতার থেকে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তার একটি বাণী প্রচারিত হয়। স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে তিনি এই বাণীগুচ্ছ হজরত মুহাম্মদ (স) এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে প্রেরণ করেন। বাণীতে লেখা ছিল: ‘ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি- এই কারণে তার অনুবর্তিগণের দায়িত্ব অসীম। … আজকের এই পুন্যানুষ্ঠান উপলক্ষে মুসলিম ভাইদের সাথে একযোগে ইসলামের মহাঋষির উদেশে আমার ভক্তি উপহার অর্পণ করে উতপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তার আশীর্বাদ ও সান্ত্বনা কামনা করি।’ হৃদয়ের অর্ঘ্য ও বিনয় শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠকুর ঠিক এর দুইবছর পর ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তার একটি শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান নয়াদিল্লির জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির জন্য। এটি মিলাদুন্নবী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি লেখেন: “যিনি বিশ্বের মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদের উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবনশক্তির সঞ্চার করেছিলেন হজরত মুহাম্মদ পয়গম্বর। এনেছিলেন নিখাঁদ শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বন্তকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যারা অনুসরণ করেছেন আধুনিক ভারত বর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তারা যেন জীবন সম্পর্কে তাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং পয়গম্বরের প্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেন। তারা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন, যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়।’
আলফানসো দ্য লে মার্টিনি তার বই “ দ্য হিস্টি দ্য লে টেরকি” তে বলেন উদ্দেশ্যের মহত্ব, লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহের ক্ষুদ্রতা এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল যদি অসাধারণ মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট্য হয় তবে কে মুহাম্মদের সাথে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবের তুলনা করতে সাহস করবে ? বেশীরভাগ বিখ্যাত ব্যক্তি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন এবং সাম্রাজ্য তৈরী করেছেন। তাঁরা যদি কিছু প্রতিষ্ঠা করে থাকেন সেটা কিছুতেই জাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি কিছু নয় যা প্রায়ই তাদের চোখের সামনে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই মানুষটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, শাসক, লোকবল-ই পরিচালনা করেননি সেইসাথে তৎকালীন বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করেছিলেন; সবচেয়ে বড় কথাহলো তিনি দেব-দেবী, ধর্মসমূহ, ধারণাগুলো, বিশ্বাসসমূহ এবং আত্মাগুলোকে আন্দোলিত করেছিলেন।
দার্শনিক, বাগ্মী, বার্তাবাহক, আইনপ্রণেতা, নতুন ধারণার উদ্ভাবনকারী/ ধারণাকে বাস্তবে রূপদানকারী, বাস্তব বিশ্বাসের পুনরুদ্ধারকারী…..বিশটি জাগতিক এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা-এই হলো মুহাম্মদ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে তার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি- মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ আছে কি ?
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে নিয়ে আমার মতো অতি নগন্য মানুষের ছোট চিন্তা। আরবের ইতিহাস পড়তে গেলে জানতে পারবেন। মহনবী (সঃ) জন্মগ্রহণের পূর্বে সেখানে কি নরকনগর ছিলো। কণ্যা শিশু জন্মগ্রহণ করলে প্রকাশ্য হত্যা করা হতো। নিয়মিত চলতো মারামারি, হানাহানি, খুনাখুনি, লুটতরাজ, ধর্ষণ সহ এমন কোনো কাজ নেই হতো না। আমাদের প্রিয় নবীজি যখন মায়ের পেটে তখন তাঁর বাবা মারা যান। যখন তাঁর মাত্র ছয় বছর বয়স তখন মাকে হারান। এতিম সন্তান। দাদাজান চলে যান তিনি একা হয়ে যান। মা, বাবা, দাদা ছাড়া সেই ছোট্ট শিশুটি দিন দিন বড় হতে থাকেন। আলোর ফুলকি ছড়াতে থাকেন। নবীজি এমন কি আলো দিলেন একজন মানুষ পুরো আরোবকে অন্ধকার মুক্ত করলেন। পুরো জগতাটাকে আলোর ডাক দিলেন। ভাবতেই অবাক হই মহান আল্লাহ পাক কি না পারেন। একজন এতিম সন্তান এক এক করে সবাইকে আলোর দিকে টেনে আনলেন। আজকে ১২ই রবিউল আউয়াল মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি সেরা দিন। যে দিনটিতে আমাদের প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনটিতেই তিনি চলে যান এই জগত থেকে। গভীরভাবে বিনম্র শ্রদ্ধা ও হাজার কোটি দরুদ, সালাম জানাই প্রিয় হাবীবের রওযায়। মহান আল্লাহ পাক সবাইকে নবীজির আর্দশে চলার তৌফিক দান করুক।(আমীন)
Add Comment