গল্প

“টুলুদির শাড়ির গন্ধ”

মডেল: ফারহানা ফারা

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

তপন রায়প্রধান (পশ্চিমবঙ্গ)

কিছু কিছু গন্ধ আমার আবহমানের ভালোলাগা। যেমন নতুন চালের ভাত, গোবর-লেপা উঠোন, ধুনো, নতুন ফুলকপি দিয়ে জিয়োল-শোলমাছের ঝোল, মায়ের মুখের পান, নতুন বই, সুলেখা কালি, নতুন জুতো, কার্তিক মাসে ডাকলক্ষ্মীপুজোর দিনে ধানক্ষেতে ‘দল-খৈল’ ছিটয়ে দেওয়ার পর বাতাসে ভেসে বেড়ান ম ম গন্ধ- তা-ও।

বেশ মনে আছে, জীবনের প্রথম জুতো কিনতে হয়েছিল, আকাশবাণীতে ঘোষকের চাকরি পাকা হবার পর। তাও শখে নয়; ঠেলায়! ছোটবেলায় আমার কোনো জুতো জোটেনি। কলেজে না, ইউনিভার্সিটিতে না। যখন ইউপিএসসি’র ফাইনাল ইন্টার্ভ্যুতে আকাশবাণী-দূরদর্শনের ‘প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ’ পদের জন্য ডাক পেলাম; সহকর্মীরা পরামর্শ দিলেন; নো চটি- শ্যু মাস্ট। সেই প্রথম জুতো কেনা। দুটো দিন তো প্যাকেট খুলে খুলে শুধু গন্ধই নিয়েছিলাম। তারপর জুতো পরে হাঁটা প্র্যাকটিস। ঘরেই। জড়তা যা কিছু কেটে যাক বাবা! জড়তা কাটলেও, ভালোলাগার সেই গন্ধটা ছেড়ে গেল না!

এরকমভাবে প্রতিটি প্রিয়-গন্ধের নেপথ্যে একেকটি গল্প লুকিয়ে আছে। যেমন টুলুদি’র শাড়ির গন্ধ। তারই সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুটি অনাবিল অনুষঙ্গ। সরস্বতী পুজো আর একটি গান।
টুলুদি, আমার এক বৌদির ছোট বোন। সবে কলেজে ঢুকেছে। আমি তখন নাইন। ওঁদের মূল বাড়ি গ্রামে। পরে জলপাইগুড়ি শহরে বাড়ি কেনে; ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর জন্য। টুলুদি জলপাইগুড়ির বাড়িতেই থাকতেন। ছুটিছাটায় আমগুড়ির বাড়িতে যেতেন। টুলুদিকে প্রথম দেখি দাদার বিয়েতে। সুন্দরী তো বটেই; আলগা একটা আকর্ষণ ছিল টুলুদির গজদন্তি হাসিতে; যা এক ঝটকায় চোখ কেড়ে নিত। ভালো লাগত টুলুদির কাছেপিঠে উপস্থিতি! কিছুই না অথচ যেন অনেক কিছু! সরে গেলে মনে হতো, আলোর মাঝেও হঠাৎ যেন নিভে গেল কোনো আলো!
সেই আলোর মতো টুলুদি একবার হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে আমাদের হলদিবাড়ির বাড়িতে এসে উঠলেন। জানা গেল, দিন পনের কি প্রয়োজনে তারও কিছু অধিকদিন থাকবেন। বৌদি সন্তানসম্ভবা। আমাদের বাড়িটা, অন্যত্র উল্লেখ করেইছি; বারো ঘর এক উঠোন। যে কোন বাড়িতে পাত ফেললেই হলো। ফলে খবরটা জেনেই আমার বুকের ভেতর ‘কাঁসর-ঘন্টা উলুধ্বনি’! হয়তো কিছুই না আবার সেই অনেককিছু!

দুজনের বয়সের ফারাক বছর চারেকের। বয়স এবং সম্পর্কের সুবাদেই, অচিরেই দুজনের মধ্যে মিষ্টি একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্কুল থেকে ফিরে একবার দাদাদের বাড়ি না গেলে যেন ভাত হজম হতো না। মনে হতো যেন টুলুদির মনেও কোথাও একটা অপেক্ষা কাজ করত। নাও হতে পারে কিন্তু আমার মনে হতো। নইলে আমায় দেখে টোল-পড়া-গালে টুলুদির হাসি কথা কয়ে উঠবে কেন! মাঝেমাঝেই বৌদির অনুমতি নিয়ে বিকেলটায় আমরা এদিকওদিক বেড়িয়ে আসতাম। কাছেই। কোনদিন মেলারমাঠের রাস্তায় পায়চারি খাওয়া, কোনদিন পরিত্যক্ত বাংলাদেশের রেললাইন ধরে হুজুরসাহেবের মাজার দেখা.. কোনদিন স্টেশনে গিয়ে ঝালমুড়ি.. এই পর্যন্তই।

সেরমই এক বিকেলে টুলুদি আচমকা এক গোপন কথা বলল আমায়। তার আগে তাঁর দিব্যি দিয়ে বলিয়ে নিল, কথাটা যেন কাউকে না বলি। শুনে একটা জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম মনে; টুলুদিকে অবশ্য বুঝতে দিইনি। চুপ করে হাঁটছি শুধু।
নীরবতা ভাঙল টুলুদিই- শোন তোকে একটা কাজ করে দিতে হবে আমার।
-বললাম, কি?
-ও না, কাল হলদিবাড়ি আসবে বিকেলের ট্রেনে। আমি তো দেখা করতে পারব না। দূর থেকে তোকে চিনিয়ে দেব। একটা চিঠি দেবে। তুই আমায় দিবি। পারবি?
– বললাম, হ্যাঁ।
টুলুদি প্রায় একমাস ছিল। উনি সপ্তায় দুদিন জলপাইগুড়ি থেকে এসে এভাবে চিঠি দিতেন। টুলুদির চিঠি পেতেন আমার হাত থেকে। তবুও টুলুদিকে নিয়ে বেশ কাটছিল দিনগুলো। টুলুদির যাবার সময় হয়ে এলো। সরস্বতীপুজোর পরের পরেরদিন চলে যাবে। টুলুদির চোখে এবার আমার মনখারাপ আর গোপন থাকেনি। তাই দাদা-বৌদিকে বলে পুজোর দিনটা সারাদিন আমরা হলদিবাড়ির পুজোগুলো দেখব, ঠিক করে ফেলল।

সুন্দর করে সেজেছিল টুলুদি। কিছুই না তবু অনেক কিছু। বৌদির একটা আনকোড়া লালপাড় সাদা শাড়ি। বিয়েতে পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে লাল ব্লাউজ। এটুকুই। কপালে শুধু ছোট্ট একটি চন্দনের টিপ। দেখে অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইলাম। টুলুদি বলল- কি রে, হা করে কী এত দেখছিস!
‘খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে! এই-ই প্রথম টুলুদিকে মুখ ফসকে ‘সুন্দর’ বলে ফেললাম! হয়তো আর বলা হয়ে উঠবে না ভেবেই বলে ফেললাম। অনুভব করলাম, হঠাৎ গলাটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে! বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছি কানে!
তখন থ্যাঙ্কিউ-ট্যাঙ্কিউ বলার বালাই ছিল না। টুলুদি খানিক হেসে, আমার মাথার চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বলল- চল, যাই..

সারাদিনে প্রায় সবক’টি স্কুল আর প্যান্ডেল ঘুরে যখন ফেরার পথ ধরেছি- তখন সূর্য ডোবার পালা। বাড়িতে পইপই করে দাদা বলে দিয়েছেন, সন্ধের আগে ফিরতে। আমরা এবার শর্টকাট পথ ধরি। আলপথ। আলপথ জন্যই চাপাচাপি হাঁটতে হচ্ছিল। যাতে পড়ে না যায়, সেই ভয়েই কি না জানিনা, টুলুদি আমার হাত ওঁর হাতের মুঠোয় জড়িয়ে নিলেন। আরেক হাতে মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে বলল- ‘তোকে খুব মিস করব জানিস’? আমার গলা বুজে আসছিল। নাকে এসে লাগছিল টুলুদির গায়ের গন্ধে মাখা নতুন শাড়ির গন্ধ। অনাস্বাদিত এক মাদকতায় ডুবে যাবার জন্য বুকের ভেতরে আবার সেই তৃষ্ণা.. সেই ‘কাঁসর ঘন্টা উলু’..

দূরের কোন প্যান্ডেলে তখন বাজছিল ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়’…
আমার জমে ওঠা কথাগুলো, না ঝরা কান্নাগুলো, না বলা অভিমানগুলো, সব কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল, সে গানের সুরে সুরে…
টুলুদি কি টের পেয়েছিল তা?

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930