গল্প

বৈপরীত্য

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-সালেহ রনক

পর্ব- ০২

তিন
গলির মোড়ে এক মহিলা পিঠা বিক্রি করেন। বেশ ভালো চিতই ও ভাঁপা পিঠা বানান। নানা রকম ভর্তায় মোটামুটি পিঠা বিলাস হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তাকে কাঁচা ডিম ভেঙে দিয়ে চিতই পিঠা বানাতেও দেখি। খেতেও বেশ মজা। আজ বউয়ের খুব ইচ্ছা হলো চিতই পিঠা দুধ দিয়ে রান্না করে খাবে। দুধ চিতই আমারও ভীষণ প্রিয়। পঁচিশটি পিঠার অর্ডার দিয়ে একটু পাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি সিমরিনের মা এসে হাজির সেখানে। আমাকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি এখানে? ”
পিঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
আমিও পিঠা নিতে এসেছি। ওর পিঠা অনেক ভালো।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম, “জ্বী”।
ভদ্রমহিলা যখন পিঠা নিয়ে কথা বলছে দোকানীর সাথে, আমি তখন খেয়াল করে দেখলাম তিনি যথারীতি আজও বেশ পরিপাটি সাজে সজ্জিত। আজ যা নতুন করে খেয়াল করলাম তা হলো তিনি চোখের পাতায় নানা রঙও ব্যবহার করেন চোখ রাঙাতে। গালে কুমকুমও মেখেছেন কিছুটা অংশ আপেলরাঙা বানাতে। পায়ে অল্প হিলের জুতো। আমার মাথায়ই ঢুকছে না মানুষ সারাক্ষণ এমন সেজেগুজে থাকে কিভাবে? নাকি যেদিন সাজে সেদিনই আমার সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যায়।
দোকানী আমাকে দেয়ার জন্য যে পিঠা ভেজে এতোক্ষণ জমা করেছিল সিমরিনের মা সেখান থেকে ১০ টি পিঠা নিয়ে চলে গেল। সাথে নানা পদের ভর্তা। যাওয়ার সময় আবারও একগাল হাসি দিয়ে বললো, আচ্ছা আসি। বাসায় আসবেন একদিন ভাবীকে নিয়ে।”
আমি কোন রকমে মুখে হাসি টেনে বললাম, “জ্বী আসবো। ”
আমার জন্য রাখা পিঠাগুলো নিয়ে যখন তিনি চলে যাচ্ছেন আমি তখন না পারছি কইতে না পারছি সইতে। আমি পিঠা নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম বউয়ের তখন অগ্নিমূর্তি। দুধ জ্বাল দিতে দিতে ক্ষীর বানিয়ে ফেলেছে। শুধু ঐ দুধে আমাকে চুবানো বাকি। তিন তলার ভাবীর কান্ড শুনে তেলেবেগুনে আরও জ্বলে উঠলো।

এই ব্লিডিংএ কি আর কোন পুরুষ থাকে না?
থাকবে না কেন? আমি উত্তর দিলাম।
মনে তো হয় না
কি মনে হয় না?
ঐ যে ভাবীর সাথে শুধু তোমারই দেখা হয়ে যায়। তা বাসায় চা খেতে যেতে বলেনি?
হুম বলেছো তো। আজই বললো।
ও আচ্ছা!! এতো দূর! তা গেলে না কেন? চা টা খেয়ে তারপর আসতে পিঠা নিয়ে।
ভাবগতি সুবিধার মনে না হওয়াতে চুপ করে গিয়ে রুমে ঢুকলাম।

চার
দ্বিতীয় তলার রশিদ সাহেবের মেয়ের ঘটা করে জন্মদিন পালিত হচ্ছে। পুরো ছাদ জুড়ে বিশাল আয়োজন করেছেন। এই ব্লিডিংয়ের এর সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আমিও সপরিবারে আমন্ত্রিত হয়েছি।বউ অফিসে থাকাতে সন্ধ্যার একটু পরে বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হয়েছি অনুষ্ঠানে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার স্ত্রীর অফিস শেষে এসে অনুষ্ঠানে যোগ দিবে। এক জায়গায় চেয়ার ফাঁকা পেয়ে সন্তানদের নিয়ে বসে পড়লাম।সামনের স্টেজে তখন হিন্দি গানের তালে ছেলে মেয়েরা নাচ পরিবেশন করছে। নৃত্যরতদের মাঝে সিমরিনকেও দেখতে পেলাম। সম্পূর্ণ ওয়েস্টার্ণ সাজে মেয়েটিকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। লেজার আলোতে মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে মনটা বেজার হয়ে গেল কেন বুঝতে পারলাম না। ছেলে মেয়েকে বসিয়ে রেখে অস্বস্তি থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেই উঠতে যাচ্ছি, ঘাড় ঘুরাতেই দেখি পাশে সিমরিনের মা দাঁড়িয়ে। একগাল হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন আছেন? ”
জ্বী ভালো আছি।
আপনি কেমন আছেন?
আর বলবেন না, সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম।
কেন? আজও কি বাসায় মেহমান এসেছেন?
না আজ মেহমান আসেনি। মেয়ে পারফর্ম করবে তাই তার প্রাকটিস ও কস্টিউম নিয়ে কত যে কষ্ট করতে হয়েছে!
আমার মেয়ের নাচ কেমন লাগছে?
জ্বী ভালো ।
আপনার মেয়ে জানি কোন ক্লাসে পড়ে?
ও মা এরই মধ্যে ভুলে গেলেন! ক্লাস টেনে।
ও হ্যাঁ মনে পরেছে।
এই শুনছো, এদিকে এসো। তোমার সাথে একজনকে পরিচয় করিয়ে দিই।
ভদ্রমহিলার ডাক শুনতে পেয়ে কোট প্যান্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক এসে হাজির।
এই ভাই চার তলায় থাকেন। বেশ মিশুক।
ভদ্রমহিলার মুখে মিশুক শব্দটি শুনে আমার কেমন যেন লজ্জা পেল। কথাই বলেছি হাতেগোনা দুই একবার। কি কারণে তিনি আমায় মিশুক বললেন ভেবে পেলাম না। তাও আবার তার হাজবেন্ডের সামনে। আমার অবস্থা লজ্জায় মরি মরি।
হ্যান্ডসেক করে দুজনে পরিচয় বিনিময়ের পর হালকা আলাপে মেতে উঠলাম। ভদ্রলোক পুরোটা সময় কাচুমাচু করেই সময় পার করলেন। বুঝলাম স্টিয়ারিংটা ভদ্রমহিলার হাতে।
আজ সিমরিনের মা পার্টি সাজে প্রায় সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কী পরেননি? কানে বড় ঝুলানো দুল,মাথায় টিকলি, হাতভরা স্বর্ণের চুড়ি, দুহাতের সবগুলো আঙ্গুলে নানা পাথরের রিং শোভা পাচ্ছে। জরির কাজ করা ভারি শাড়ি সাথে স্লিভলেজ ব্লাউজ পরেছেন। মুখে কড়া মেকাপ।
আমার স্ত্রী সোজা অফিস থেকে এসে বাসায় না ঢুকে অনুষ্ঠানে চলে এসেছেন। ইতিমধ্যে খাবারের পর্ব শুরু হয়ে গেছে। এক ফাঁকে ভদ্রমহিলা এসে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হয়ে গেছেন। খাবার শেষ করে সবাই অপেক্ষা করছে রশিদ সাহবের মেয়ের কেক কাটার জন্য।
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ এশা
হ্যাপি বার্থডে টু ইউউউউ….
সমস্বরে সবাই গেয়ে চলছে। এর মাঝে সিমরিনের মা এক সুদর্শন যুবককে নিয়ে এসে হাজির। বেশ লম্বা ও শ্যামলা বর্ণের যুবকটি সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল।
আমার একমাত্র ছেলে মাসউদ। ব্যাংকে চাকুরি করে। বেশ ভালো বেতন পায়। ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছি বিয়ে করাবো বলে।
মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে ছেলেটা একটু লজ্জা পেল।
মা তোমরা কথা বলো, আমি একটু নিচে যাচ্ছি। আংকেল বাসায় আসবেন সবাইকে নিয়ে।
ঠিক আছে বাবা আসবো একদিন । স্ত্রীর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, যেন সে সম্মতি দিয়েছে ওদের বাসায় যাবে।
সিমরিনের বাবাকে পুরো অনুষ্ঠানে খুব একটা কথা বলতে দেখিনি। এই প্রথম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মামুন সাহেব আপনি কি করেন জানাই হয়নি এখনো?

আমি বিজনেস করি। আপনি কি করছেন?
আমি ডেসাতে কর্মরত ছিলাম। এই বছর মার্চে অবসরে এসেছি।
স্ত্রীর ক্লান্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না। বিদায় নিয়ে চলে যাবো বলে পা বাড়িয়েছি মাত্র। সিমরিনের মা আবার পিছন থেকে ডেকে বললেন, “ভাই একটা অনুরোধ করবো আপনারা যদি কিছু মনে না করেন। ”
না না কিছু মনে করবো কেন? আপনি বলুন শুনছি।
এবার আমার স্ত্রীই উত্তর দিলো।

ছেলেটার জন্য পাত্রী খুঁজছি। মন মতো পাচ্ছি না। আপনারাও একটু দেখবেন প্লিজ। ভালো পাত্রী হলে আমাদের আর কিছুই চাই না।
কেমন পাত্রী চাচ্ছেন জানালে আমাদের পরিচিতদের মধ্যে কেউ থাকলে বুঝতে সুবিধা হতো। আবারও আমার স্ত্রী জানতে চাইলো।
খুব পরহেজগার একটা মেয়ে চাই। যে শুধু মন দিয়ে সংসার করবে। আমার সংসার আর আমার ছেলের জীবনটাকে শান্তিতে ভরে দিবে।

সিমরিনের মায়ের মুখে পরহেজগার শব্দটি শুনতে পেয়ে আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই যেন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শুধুমাত্র ছোট্ট করে “জ্বী আচ্ছা মনে থাকবে “বলে বাসায় ফিরে এলাম।
রুমে ঢুকে স্ত্রীর প্রথমেই বলে উঠল, ” “এই তোমার পরিপাটি সাজের ভদ্রমহিলা! এমন অদ্ভুত সাজে জীবনে কাউকে দেখিনি। মুখে যেন বার্জারের কৌটা ঢেলে দিয়েছে। এতো দিনে আমার সাথে থেকে এই চিনলে আর শিখলে? ”
আবহাওয়া অনুকূলে না দেখে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলাম পরিবেশ শান্ত হবার অপেক্ষায়।

ভিতরে বসে শুনতে পাচ্ছি বউ তখনও সমানে বলে যাচ্ছে। সবকিছু স্পষ্ট শুনতে না পেলেও বার কয়েক পরহেজগার শব্দটি শুনতে পেলাম।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930