স্বপ্ন বুনতে আসা মানুষগুলো দুঃখ নিয়ে ছাড়ছে ঢাকা। প্রতিদিন এমন তথ্য সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। ট্রাকে মালামাল বেধে শহর ছাড়ছেন অসহায় মানুষগুলো। ঠিকানা আবার সেই গ্রাম। যাকে বলে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পাড়া-মহল্লার প্রতি বাড়িতে এখন সাটানো টু-লেট। বাড়িওয়ালারাও রীতিমতো বিপাকে।
কর্মজীবী, নিম্ন মধ্যবিত্তদের সাথে মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারও নিরবে শহর ছাড়ছেন। আসলে আমার মনে হয় আমাদের লাইফস্টাইলে জামেলা ছিলো। শো অফ খুব বেশি ছিলো, হিসাব-নিকাশ ছাড়া। নইলে অন্তত ছয় মাস কেন চলা গেলো না। কিছু টাকা কী জমানো নেই? যা দিয়ে আরো কয়েক মাস চলা যেতো। আসলে যতটুকু ইনকাম, কালের স্রোতে গা ভাসাতে যেয়ে ব্যয় হয়েছে তার চেয়ে বেশি। স্ট্যাটাস দেখাতে যেয়ে সামর্থ্যর বাইরে যেতে হয়েছে। সামর্থ্যে ছিলো নিচ তলায় থাকার থেকেছি উঁচু তলায়।
সেভিংসের কথা চিন্তা না করে অঢেল খরচ করতে যেয়ে আজ এই পরিস্থিতি। ৯০ দশকের দিকেও এতো উন্নত ছিলো না চারপাশ। তখন মানুষগুলো খেয়ে পড়ে মাস শেষে কিছু টাকা জমাতো। তখনকার মানুষগুলো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতো। এখন পরবর্তি সময়ের কথা না ভেবেই চলছি সবাই।
সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে, ফ্যাশন আর শো অফের দুনিয়ায় ডুব দিয়েছে সবাই। এখনকার মানুষের কার্ড ভর্তি লোন, ইন্সটলমেন্ট, ব্যাংক লোন এছাড়া আয়ের দিকে না তাকিয়ে স্ট্যাটাস মেন্টেন করতে যেয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র টাইলসওয়ালা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া। পাশের বাড়িতে নতুন এসি ঝুলছে, এটা দেখে তারচেয়েও বড় এসি কেনা। সপ্তাহে বড় বড় রেস্টুরেন্টে হাজার হাজার টাকা নষ্ট, মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখা, ফেসবুকে দু’চারটা ছবি দিতে মান সম্মান রক্ষার্থে বছরে লোন করে হলেও দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া। উবার ছাড়া অনেককে তো চলতেই দেখিনি। নামীদামী পার্লার / সেলুনে গিয়ে চামড়া চকচকে করতে পারলেই যেন মনের তৃপ্তি! এছাড়া দিবসগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পকেটের বারোটা বাজানো তো আছেই!
এসব বাজে খরচ না করে, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে প্রতি মাসে যে পাঁচ সাত হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে, সেটা জমালে বছরে ৬০-৭০ হাজার টাকা সঞ্চয় হতো। দশ বছরে যদি হিসাব টানি তাহলে ৬-৭ লাখ টাকা। যা দিয়ে এখন ৫-৭ মাস আরামে কাটানো যেতো।
প্রতিযোগিতামূলক সমাজে পাল্লা দিতে নিজেকে লাক্সারিয়াস করতে সঞ্চয়ের কথা ভুলে-ই গেছি। আপতকালীন মোকাবিলা করতে হতে পারে এমন ধ্যান-ধারণা কখোন-ই ভেবে রাখিনি। এসব শিক্ষাগুলো মূলত আসে পরিবার থেকে সেটাও কী হচ্ছে? বিয়ে করার পরের মাসেই বৌয়ের কথামতো আলাদা সংসার শুরু করা। আর যৌথ পরিবার কী ছিলো এটাতো বর্তমান প্রজন্ম জানেই না! তাহলে সেই জ্ঞান বোধটুকুর বা জন্ম নেবে কোথথেকে।
গত কয়েক বছরে এই শহরে মধ্যবিত্ত বলতে আমি কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না। সবার ঠাট বাট প্রায় একইরকম লাগতো। যেদিকে দেখতাম সবই সমান মনে হতো। কারো চেয়ে কেউ কম না। কিন্তু এ করোনাভাইরাস কয়েক মাসে তা দেখার সুযোগ করে দিয়েছে!
এত ভোগবিলাসী জীবন-যাপন করতে যেয়ে নিজেকে এমন আকর্ষণীয় পণ্য বানিয়ে ফেলেছি যে― দুই তিন মাসের ভবিষ্যতের নিরাপত্তাটা ভাবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। আর যাদুর শহর থেকে বাস্তবতা মেনে বিদায় নেয়াটাও দুঃখজনক মনে করছি।
লেখক- মিলন মাহমুদ রবি, গণমাধ্যম কর্মী
Add Comment