অনু গল্প

‘শকুনি’

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-নাসরিন আক্তার

হারামির ঘরের হারামি, জাউড়ার ঘরের জাউড়া, গোলামের পুত আয়, কাছে আয় এক কোপে কল্লাডা নামায়ালবাম। ফালানিরে অহনো চিনছোস না!!
– – – বলতে বলতে ফালানি দাঁ উঁচিয়ে ঘরের দাওয়ায় বেরিয়ে আসে।
মধ্য দুপুরের গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার, জলন্ত আগুনের মত ফোঁসফোঁস করে। দাঁ হাতে রোদে পোড়া ডান হাতটা দেখলেই বোঝা যায় এক সময় এই মেয়ের রূপ যৌবনের কমতি ছিলো না। ত্রিশ পার করে এসেও তার এতটুকু কমতি নেই শুধু রোদে পোড়া শরীর ছাড়া। ব্লাউজ ছাড়া আটপৌরে শাড়ির উপর দিয়ে সুঢৌল বুক আর বেখেয়ালে নাভিমূলের কাপড় সরে গেলে এখনে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। মুখটা এখনও সেই কৈশোরের মতোই নিষ্পাপ।
লোক মুখে শোনা কথা, ফুটফুটে শিশুকন্যা ফালানির অসুখ বিসুখ লেগেই থাকতো তাই ফালানির মা লোকের বদনজর থেকে বাঁচাতে মেয়ের নাম রাখেন ফালানি’।
ওর একটা ভালো নামও আছে তবে এতো দিনে ফালানি নিজেও সে নামটা মনে রাখতে পারেনি। ফালানিদের মূল নাম মনে থাকেনা…
গত আশ্বিনে সরকারি রাস্তায় মাটি কাটতে যেয়ে রমিজ কোমরে ব্যথা পায়, অনেক জুড়ি-বুটি ও কবিরাজি মালিশ করেও তা পুরোপুরি সারেনি আজও। এখনো প্রায়ই টনটন করে। তখন টানা একমাস বিছানায় পড়ে ছিলো রমিজ।
ঔষধ, পথ্য, চারচারটা মুখ!!!
অভাবের সাথে যুদ্ধ করে ফালানিকেই কাজে নামতে হয়। কাজ নেয় পাশের ধানভাঙা কলে। সারাদিন রোদেপোড়া খাটুনি সয়ে যাচ্ছিলো হাসি মুখেই, গরিবের দুবেলা দু’মুঠো ভাতই স্বর্গসুখ। কিন্তু এই শরীরটাই সকল অনর্থের মূল হলো…
গরীবের বউ সবার ভাবি…
-ফালানি রোদে পুড়ে ধানে ময়ান দেয়, আগুনে তেতে ধান সেদ্ধ করার, চুলোর আগুন উস্কে দেয়- এর ফাঁকে সরে যাওয়া বুকের আঁচল ঠিক করতে যেয়ে চোখে পড়ে কিছু শুকুন চোখ। তবুও নিজেকে যতোটা ঢেকেঢুকে কাজে মন দেয়।
কিন্তু যেদিন ম্যানেজার নিজের রুমে ডেকে চকচকে লোভাতুর টোপ ধরে ফালানির সামনে,
–আল্লায় দিলে গতর খানা ভারি সুন্দর। তোর মতো মাইয়া মাইনষ্যার এতো কাম করুণ লাগে?! আয় আমার একটু সেবা যতন কর, তরে পুশায়া দিমু…
রাজরানী হইয়া বইয়া বইয়া খাইবি, এই চাতালের বেবাকের উপরে মতব্বরি করবি বুঝলি?!
বলতে বলতে লকলকে জিভ দিয়ে ঝোলটানে। চোখের ইশারায় কাছে ডাকে। ঠিক তখনি ফালানির মাথায় রক্ত চেপে যায়। ম্যানেজারের মুখে থুতু ছিটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
–সেদিন থেকেই ফালানি পাল্টে যায়। এই ফালানিকে ধানকল বা গ্রামের অনেকেই চিনতে পারেনা। হাফাতে হাফাতে ফালানি আরো একদফা ঝাল মিটায়।
–হারামজাদার ঘরের হারামজাদা, আমি সুহে আছি না দুঃখে আছি তরারে কইতাম ক্যারে??? ওরে আমার রসের নাগর আইছে! তোরা আমারে ভাত দেস না কাপড় দেস? আমার সোয়ামি আমারে ভালা পায়, না পায় না, তরা জাইন্যা করবিডা কি?
–বান্দির পুতাইন! ভালা পাইলেও হ্যায় আমার সোয়ামি, না পাইলেও হ্যায়ই আমার সোয়ামি। আমার পোলাপানের বাপ, আইজ বিছনাত পইরা থাকলে হ্যায়ই ঔষধ পথ্যি করবো। তহন কোন চান্দুর মুখ দ্যাহা যাইতো না। তরা অইলি আন্ধারের চিহা, রসের মাছি, রস খাইবার লাইগ্যা ছুকছুক করস, দিনের আলোয় আন্ধারে মুখ লোহাস।
–আমারে তালের রসের হাড়ি ভাবছো, না!?
ফালানির চিল্লাচিল্লির মহরায় থাকতে না পেরে পাশের বাড়ির ষাটোর্ধ রমিছা বেরিয়ে আসে।
–অলো বেডি, অহন চুপ কর, আর কত চিল্লাস? নিজেরে একটু ডাইক্যা ডুইক্যা রাখলেই পারস। ঘরের জালনা কপাট খোলা থাকলে হ্যায়াল শহুন তো চোখ তাতাইবোই। নিজের হেফাজত নিজে কর বেডি।
কথাটা শুনে ফালানি আরো তেতে উঠে- চাচি এইডা তুমি কি কইলা?! মাইয়া অইয়া মাইয়া মাইশ্যারেই কতা হুনাও? আর ঢাকতাম না, আমি স্বাধীন মানুষ, এই শইল আমার, আমার যেমনে মনচায় তেমনে চলুম। দেহি কোন ব্যাডা কাছে আহে? এক কোপে ঘারথন কল্লাডা নামায়ালতাম না?!
দুনিয়াডা হ্যায়াল শহুনে ভইরা গেছে, ম্যাইয়াগো অহন অস্ত্র হাতে লউন লাগবো বুঝছো! নিজে বাঁচুনের লাইগ্যা…
হুনো চাচি, “দুনিয়াই হইলো শক্তের ভক্ত নরমের যম। বিলাই কহনো শক্ত মাডিত হাগেনা, জানো না”?!
ফালানি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তখনি দেখতে পায় রমিজকে- খেতে আসছে। রমিছা চোখ টিপে, এই টিপের অর্থ রমিজকে কিছু বলা যাবে না। রমিজ বাড়িতে ঢুকার মুখে দা হাতে ফালানিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে- কিরে এমুন জল্লাদনীর মত খারাইয়্যা আছোস ক্যা?
–না, এমনি বাড়ির জংলা পরিষ্কার করি। ফালানি নিজেও জানে, সব কথা সোয়ামীদের বলতে নেই, নয়তো একদিন ওকেই বলে বসবে- তুই পশ্রয় দিছোস দ্যাইখ্যাই ওরা সাহস পাইছে, নইলে বারবার তোর কাছে আহে ক্যান!?
এই সমাজে সব জায়গাতেই মেয়েদের দোষ, সহজ-সরল, পল্লীবধু ফালানিরো এই কথাটা অজানা নয়।
রমিজ তাড়া দেয়- আয় ঘরে আয়, বউ খাউন দে, খুউব খিদা লাগছে। হেই বিয়ান বেলা কয়ডা পান্তা খায়া বাইরইছি।
ফালানি ভাত বাড়তে থাকে, হাড়ি বাটির টুংটাং শব্দের সাথে ভেতরে ঘুরপাক খায়- স্বামী, শকুন আর বুক থেকে সরে যাওয়া অবিন্যস্ত আঁচল…

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930