জীবনমঞ্চ

খুলনার সাংস্কৃতিক জাগরণ ও আকরাম হোসেন

-নাজমুল হক লাকি

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষকে নতুন এক উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার উপর যতই আক্রমন করছিল, বাঙালিরা ততই তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরছিল পরম মমতায়। অবশেষে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের রক্ত দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো বাংলার আনাচে কানাচে। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হলো বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণও। উনসত্তরে এসে উত্তাল গণ-জাগরণের ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। মফস্বল শহরগুলোও আলোড়িত হলো সে ঢেউয়ে। সংস্কৃতি আর রাজনীতি তখন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতার দিকে।

১৯৬৯ সাল। ডাকবাংলো আর পিকচার প্যালেস সিনেমাহলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ছোট্ট মফস্বল শহর খুলনা। খুলনার পাড়া-মহল্লার সাংস্কৃতিক জাগরণ তখন তুঙ্গে। সব উপলক্ষকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হতো গান-কবিতা-আলোচনা মিলিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, চারুশিল্পী, নাট্যশিল্পীসহ সবাই যুক্ত হতেন। খুলনা শহরে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন, গানের স্কুল এবং ব্যক্তিকে ঘিরে সংগীতশিক্ষা, সাহিত্য আসর সক্রিয় ছিল। বছরব্যাপী নানা উপলক্ষে অনুষ্ঠান হতো, সবাই জমায়েত হতেন পিকচার প্যালেস মোড়ের অদূরে শহীদ হাদিস পার্কে। দেখতে দেখতে চলে এলো পূর্ব পাকিস্তান মিউজিক এন্ড ড্যান্স প্রতিযোগিতা।

১৯৬৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের এ প্রতিযোগিতায় সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে মাত্র একুশ বছরের প্রতিভাবান তরুণ আকরাম হোসেন গীটারে প্রথম স্থান অধিকার করে জিতে নিলেন স্বর্ণপদক। কিছু কিছু মানুষের জীবন যে গল্পের চেয়েও ঘটনাবহুল থাকে আর রূপকথার চেয়েও হয় চমকপ্রদ, আকরাম হোসেনের বৈচিত্র্যময় জীবনে সে প্রতিফলন দেখা গেছে বারবার। এরপর তাঁর গীটার ও বেহালার শিক্ষক ওস্তাদ বিনয় রায় এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক ওস্তাদ সাধন সরকারের আশীর্বাদে এগোতে থাকে তাঁর সঙ্গীত জীবন।

যে কোন স্বীকৃতিই এনে দেয় সামনে এগোনোর প্রেরণা। খুলনার ঐতিহ্যবাহী এক সাংস্কৃতিক পরিবার থেকে উঠে আসা মোঃ আকরাম হোসেনের ক্ষেত্রেও ঘটলো তা-ই। বাবা মোঃ আবুল হোসেন ছিলেন নাট্যপাগল মানুষ। ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি কলকাতা গিয়েও নাটক করেছেন। মা সায়েরা খাতুন ছিলেন খুলনার হামিদ আলী গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছিলেন ভাল সঙ্গীত শিল্পীও। সেসময় খুলনায় যে কয়টি পরিবার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল এই পরিবারটি। ‘সংস্কৃতিই এনে দিতে পারে রাজনৈতিক মুক্তি’-এই ভাবনা থেকেই সায়েরা খাতুন তাঁর ছেলে-মেয়েদের গড়ে তোলেন। আকরাম হোসেনের ছোট ভাই শাহ আলম বাদল ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক এবং আজমল হোসেন ও বোন সেলিমা বেগম বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্রের স্বনামখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।

১৯৭০ সাল। রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বঙ্গবন্ধুর নৌকার পালে হাওয়া দিয়ে নৌকাকে এগিয়ে নেওয়ার সামনের সারির সৈনিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এমনই অবস্থায় ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর খুলনার গল্লামারিতে প্রতিষ্ঠিত হলো বেতারকেন্দ্র। যোগ দিলেন আকরাম হোসেন। বেতারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গানে ঝড় তুললেন গীটারে। মন্ত্রমুগ্ধ উপসি’ত দর্শক-শ্রোতা। খুলনা বেতারের সম্প্রচার শুরু হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে খুলনা বেতারে অন্তর্ভূক্ত হলেন, পাশাপাশি যন্ত্রশিল্পী হিসেবে গীটারেও হলো সংযুক্তি। এসময় তিনি সঙ্গীতে সুর দেয়ার কলাকৌশল শিখতে থাকেন রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও সঙ্গীত পরিচালক ওস্তাদ আজিজ খানের কাছে।

পরাজয়ের মুখে বর্বর পাকিস্তানিরা খুলনার গল্লামারি বেতারকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, টেপ, প্রচারযন্ত্র সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় খুলনা বেতারের সম্প্রচার। স্বাধীনতার পর বেতারকেন্দ্র চালু হলে আকরাম হোসেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন খুলনা বেতারে। এসময় তাঁর সৃষ্টি বিকশিত হতে থাকে শত ধারায়। বেতারে বিশেষ দিবসের গীতিনকশা ও আধুনিক গানে সুরারোপ করে সুধীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শুধু বেতারই নয়, বেতারের বাইরেও খুলনার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সফল মুখ হয়ে ওঠেন আকরাম হোসেন।

শিশুদের সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদেরকে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাতে হবে। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে জনাব আজিজ খানের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো স্কুল অব মিউজিক। জনাব আজিজ খান নির্বাচিত হলেন সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি আর সম্পাদক মনোনীত হলেন জনাব আকরাম হোসেন, জনাব সাধন সরকার এবং জনাব মিজানুর রহিম। এই চারজনই ছিলেন স্কুল অব মিউজিক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আজিজ খানের মৃত্যুর পর ১৯৭৬ সালে আকরাম হোসেন নির্বাচিত হলেন স্কুল অব মিউজিক এর সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি। শান্তিধাম মোড়ের হাজেরা কুটির থেকে স্কুল অব মিউজিক স্থানান্তরিত হলো শেরে বাংলা রোডে। পাশাপাশি ১৯৭৬ সালেই সাহিত্য পত্রিকা স্বরলিপির সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন।

স্কুল অব মিউজিকে কাজ করতে করতেই তিনি উলব্ধি করেন, যে শিশু যে বিষয়ে আগ্রহী তাকে সেই জগতে ছেড়ে দিতে হবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়ে তাকে ভারবাহী প্রাণী বানানো যাবে না। কারণ প্রতিযোগিতার বোঝা বইতে বইতে শিশুর সৃষ্টিশীল মনটা মরে যায়। সে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে ঠিকই কিন’ তারা সবাই সৃষ্টিশীল মানুষ হয় না। আর সৃষ্টিশীল মানুষ ছাড়া সমাজ হয়ে ওঠে পঙ্গু, বিকৃত। তাই শিশুকে প্রকৃতির কাছে নিতে হবে। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে তাদের বড় করতে হবে। এসব ভাবনা থেকেই ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন শিশু মনোজাগতিক বিদ্যালয়। স্কুল অব মিউজিক এবং শিশু মনোজাগতিক বিদ্যালয় এখনও খুলনার শিশুদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আকরাম হোসেনের জীবনটাই যেন দক্ষিণাঞ্চলের সে সময়ের অবহেলিত জনপদ খুলনার সামগ্রিক এক জীবনচিত্র, সময়ের ছবি। ১৯৮২ সালে আরও বড় পরিসরে কাজ করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান। ক্যাজ্যুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বেতারে। পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে খ্রীস্টীয়ান সেন্টার ফর মিউজিক এন্ড আর্টস-এ যোগদান করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গীত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র। বহতা নদীর মতই বাধাহীন ছন্দে এগিয়ে যেতে থাকে জীবন। ১৯৮৫ সালে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যা নিকেতন এবং ১৯৮৬ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির স্বনামখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যোগদান, তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে এনে দেয় নতুন মাত্রা। ১৯৮৮ সালে যোগ দেন অগ্নিবীণা সঙ্গীত একাডেমিতে। এদিকে ঢাকা বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমেও অব্যাহত থাকে তাঁর আরাধ্য সুর সৃষ্টি। এসময় তাঁর সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় ফেরদৌস আরা, সামিনা চৌধুরী, শাম্মী আখতারসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আয়োজিত সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের সহকারি হিসেবে কাজ করেন।

সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে-ছন্দে বহমান আকরাম হোসেনের জীবন। সুরস্পর্শে মানুষের অন্তর আলোকিত করার কাজেই যেন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। শিল্পীর জীবন সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভিন্ন, তাঁর দেখবার চোখ অনন্য, ভাবনার শক্তিও গভীর। তাইতো তিনি ১৯৯২ সাল থেকে আমেরিকায় স্থায়ী হয়েও সুরের ধারায় খুঁজে নিয়েছেন স্বপ্নলোকের ঠিকানা। হয়ে উঠেছেন বাঙালি অধ্যুষিত মিশিগান এলাকার সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব। গুণী এই মানুষটিকে আপন করে নিয়েছে দুই বাংলার বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। বাংলা গানের প্রসার ও বিস্তারে ১৯৯৬ সালে আকরাম হোসেন দক্ষিণ-পূর্ব মিশিগানে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা স্কুল অব মিউজিক। সেখানে বাঙালির বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে আয়োজন করে থাকেন বিশাল আর বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

শিল্পীর পথচলা তো থামে না, বয়ে নিয়ে চলে উত্তরাধিকার। তাঁর কন্যা এথিনা আকরাম. যিনি ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট-এ পিএইচডি, সেখানে ছড়িয়ে চলেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত মাধুরীর অনন্তধারা। তাঁর স্ত্রী মাহমুদা বেগম-এর নিরন্তর সহযোগিতা আর কর্মজীবনের অসংখ্য পুরষ্কার আকরাম হোসেনকে দিয়েছে সামনে এগোবার প্রেরণা। খুলনার মেয়র পদক থেকে শুরু করে খুলনা সিটি কলেজ, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মীলন পরিষদ, সাফ গেমস প্রতিযোগিতা, বৃহত্তর জৈন্তা অ্যাসোসিয়েশন, ১৭তম ফোবানা সম্মেলন, ইউনাইটেড কালচারাল গ্রুপ মিশিগানসহ অন্যান্য অনেক সম্মাননা তাঁর সাফল্যের মুকুটে পরিয়েছে নতুন নতুন পালক। আমেরিকার মিশিগানে বাংলা সংস্কৃতির যাবতীয় কর্মকান্ড এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনেও থাকে তাঁর সামাজিক দায়বোধ ও দেশের কথা।

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031