সাময়িকী : শুক্র ও শনিবার
০৯ ডিসেম্বর ২০২১
-শাহনাজ পারভীন
সন্ধ্যা হতে না হতেই চারিদিকে ছায়া ছায়া অন্ধকার নেমে এলো যেন। হেমন্তের এই ছাতিম প্রদোষে কেন যেন মনটা হাহাকার করে ওঠে, বুঝতে পারি না। জানতে পারি না। প্রকৃতির এক মায়াঘেরা সন্ধ্যার ঝিঁ ঝিঁ ডাকে আমিও ছুটে যাই অনন্তের পথে। এভাবে ঘোরলাগা অবস্থায় কতটা সময় আমার কেটে গেছে জানি না। সেই বিমুগ্ধ ধ্যানশেষে জেগে উঠে পাশে থাকা টেবিল থেকে আজকের দৈনিকে চোখ মেলে ধরি।‘ডোম মুন্না মর্গে মৃত নারীদের ধর্ষণ করতো’। এই লাইনটা হঠাৎই আমার চোখের সাথে আটকে যায় ওতপ্রোত। কিভাবে যে আটকে যায়, কিসে আটকে যায়, তা আমি বলতে পারবো না। সুপার গ্লু, নীল ফ্লিম, ফিল্মের ভাইরাল নায়িকার শাওয়ার নেওয়া, নাকি খোলা প্রান্তরে একাকী নির্জন দুপুরের রাস্তায় সংগমরত দুটি কুকুরের শিৎকার তা আমি বলতে পারবো না। তবে আমার শরীর অবশ হয়ে গেলো যেন, চোখ দুটি স্থির, ডান অলিন্দ ভুলে গেলো বাম অলিন্দের রক্তের প্রবাহ। আমি মৃত মানুষের মতো পলকহীন তাকিয়ে থাকি পৃথিবী থমকে থাকার মধ্যে। এ মূহুর্ত সবকিছু থমকে থেমে যায় আমার পৃথিবী থেকে। কি শুনছি আমি? পড়ছিই বা কী? মৃত মানুষের সাথে…
আসলে অপরাধ এরকমই। আজ না হোক, কাল তা প্রকাশ্যে আসবেই। যত সতর্কতা, সাবধানতা অবলম্বন করুক না কেন, অপরাধী কোন দাগ রেখে না গেলেও দাগ তাকে ছুঁয়ে থাকে ডিএনএ-র কোষে কোষে। পরীক্ষাগারের টেস্টে, আগামীর অনন্ত দিনের ক্যামেরার লেন্স আর ফোকাসে।
একটু ধাতস্থ হয়ে চোখ সরাতে থাকি আতংকে আর অপরাধবোধে। এও কি সম্ভব?
সেই যে শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ পড়েছিলাম বহু বছর আগে। বিলাসী তার সারা জীবনের বিনিময়েই রোগগ্রস্ত জীবিত স্বামী মৃত্যুঞ্জয়কে ভরসা করে পরম নির্ভরতায় আম্রকাননের ছোট্ট কুড়েঘরে কাটিয়ে দিলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অথচ সেই তার নির্ভয় আত্মা মৃত্যুঞ্জয় মারা যাবার পরে আর এক মুহূর্ত তার সান্নিধ্যে থাকতে পারে না, আতংকিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও কত গল্প, উপন্যাসে পড়েছি, আজীবনের প্রিয় জীবিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যের সম্পর্ক মুহূর্তেই পাথর হয়ে যায়। আর আজ! পৃথিবী কি এগিয়ে চলছে পৃথিবীর নিয়মে? নাকি সে উল্টো পথে হাঁটছে অবলীলায়…। চোখ এগোতে থাকে খবরের লাইনে।
‘২০১৯ এর মার্চ থেকে ২০২০ এর অগাস্ট পর্যন্ত একটি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে পাওয়া মৃত নারীদের দেহে পুরুষ শুক্রাণুর উপস্থিতি পায় সিআইডি। কিন্তু একাধিক নারীর মরদেহে একজন পুরুষের শুক্রাণুর উপস্থিতি তাদের চমকে দেয়। তারা সেই পুরুষকে চিহ্নিত করার জন্য মাঠে নামে। মরদেহে পাওয়া শুক্রাণুর ওপর ভিত্তি করে সেই পুরুষের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও কাফরুল থানার কয়েকটি ঘটনা থেকে পাওয়া ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল মিলে যায়।’
–নিশ্চয় এটি প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি ভুক্তভোগীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে।
ফরেনসিক বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তা মি. রায়হান তার অনুমানের কথাটি তারই সহযোগী রব্বানী সাহেবকে বলেন।
–অথবা হত্যার পর ধর্ষণ করেছে, এটাও হতে পারে। স্যার।
–ঠিক বলেছেন, স্যার।
–ঠিকই তো, এটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মোনায়েম সাহেব।
–এটি আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, স্যার।
–কিন্তু শেষ পর্যন্ত….?
–বিস্তারিত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের পর এর থেকে তো বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা নেই। এটাই সঠিক।
–আহ! বুকের সব রক্ত যেন শুকিয়ে গেলো। হা জীবন!
যে কোনো একজন ব্যক্তি কোন না কোনভাবে মরদেহের ওপর ‘বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ’ করছে।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে নড়ে ওঠে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। পরে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মর্গে রাখা মৃত নারীদের ধর্ষণের অভিযোগে মুন্না ভগত নামে বিশ বছরের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ডোম রজত কুমার লালের ভাগিনা মুন্না ভগত। সে তার মামার সাথেই ওই হাসপাতাল মর্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করত। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না মর্গে থাকা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে আসছিল।
‘এতো শুধু ধর্ষক নয়, সিরিয়াল কিলার হতে পারে, স্যার।
সহযোগীর এমন আশংকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়।
সিআইডির তদন্ত প্রক্রিয়ায় আরও বেশি সন্দেহ উঠে আসে,
‘প্রত্যেকটি মৃতদেহেরই ময়না তদন্ত ওই হাসপাতালের মর্গে করা হয়েছে।’ অন্য কোনো হসপিটালে নয়।
একই পুরুষের শুক্রাণুর উপস্থিতি রয়েছে মৃতদেহগুলোতে।
সিআইডি গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে নতুন ইঙ্গিত বা ক্লু পাওয়ায় প্রত্যেকটি মৃতদেহ মর্গে আনার পর তার কার্যধারা বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায় ময়না তদন্তের জন্য আনা লাশগুলো পরের দিনে লাশ কাটার অপেক্ষায় মর্গে রেখে দেয়া হতো। এ প্রেক্ষিতে সিআইডি কর্মকর্তারা মর্গে কর্মরত ডোমদের ওই মামলার ময়না তদন্তকালীন গতিবিধি পর্যালোচনা করে দেখেন যে, হাসপাতালের ডোম ঐ রাতে একাই উপস্থিত ছিলো। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য ও গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়।
মুন্না ভগত এই অপরাধে জড়িত আছে ।
আপনি কি এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন?
পাঁচটি ঘটনার সময় রাতে লাশ পাহাড়া দেয়াসহ মর্গে ছিল মুন্না।
এর চেয়ে আর কি প্রমাণ আমরা পেতে পারি?
-মুন্নাকে তো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না।
বিষয়টি টের পেয়ে তাৎক্ষনিত সে গা ঢাকা দিয়েছে।
সিআইডির সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় এবং এরই প্রেক্ষিতে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
–তবে সুরতহাল কিংবা ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে মরদেহে আঘাতের চিহ্ন নেই।
–তদন্তে মোড় ঘোরাতে হবে।
— মর্গেই মৃত নারীদের ধর্ষণ করা হতে পারে।
এই সন্দেহে তদন্ত শুরু সিআইডির তদন্ত টিম। মুন্নাকে ধরতে তদন্ত কর্মকর্তাদের নাটক জমে ওঠে। তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে।
— দেখোতো, ছবির এই যুবককে চিনতে পারো?
—না তো, এই রকম চেহারার কোনো লাশ আসে নাই, ভাই।
—আমার ভাতিজা। মেধাবী। ডাক্তারী পড়তো। হঠাৎ হারিয়ে গেছে। ওর মা সজ্জাশায়ী।
আচ্ছা, ছবি আর ফোন নাম্বার রাইখে যান। কোনো সংবাদ পাইলে ফোন দিবানে।
শুরু হয় মুন্নার সাথে সখ্যতা। সিআইডির দুই কর্মকর্তা প্রায়ই দিনে, রাতে আসতে থাকেন মুন্নার কাছে। শুরু হয় নাটকীয়তা। বেশ কয়েকদিন লাগাতার তারা মুন্নাকে ফলো করতে থাকেন। রাতে মুন্নাই থাকে এটি নিশ্চিত হতে তারা রাত ১টা বা ২টায়ও মর্গে গিয়েছেন। সম্পর্ক গাঢ় হলে, কৌশলে মুন্নার পান করা সিগারেটের ফিল্টার সংগ্রহ করেন তারা। ফিল্টার থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ’র সাথে মিলে যায় ওই পাঁচ কিশোরীর দেহে পাওয়া ডিএনএ। তখন তদন্তে আবারো নাটকের মোড় নেয়। মুন্নাকে গ্রেফতারের পর বিভিন্নভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
-এইটা তুমি কেনো করতে?
সিআইডির প্রশ্নের উত্তরে সে হকচকিয়ে সত্যটাই সামনে নিয়ে আসে।
–রাতে রানুর সাথে কথা বলার পর আমার রক্ত গরম হয়ে যেতো। আমি দিশেহারা হয়ে যেতাম। বুঝে উঠতে পারতাম না কিছুই। তখন…
রানু কে?
আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। রানুর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হইছে।
তাই বলে তুমি, এই কাজ?
আমি জানি না, কি হতো আমার। আমি আমাকে আর ঠিক রাখতে পারতাম না।
তাই বলে এই বিকৃত কাজে লিপ্ত হতে? আশ্চর্য! মৃতদেহের সঙ্গে সেলফিও তুলতে তুমি?
মুন্নার মোবাইল ঘেটে মানসিক বিকৃতির আরও অনেক তথ্য প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। তারা যেন সবকিছু ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না।
মৃতদেহের সঙ্গে সেলফি তুলতে কেনো?
না, সবার সাথে না।
তবে?
শুধু ভালো লাশের সাথে।
লাশের আবার ভালো খারাপ কী?
–অল্প বয়সীদের সাথে। তারা ভালো।
–আর খারাপ?
— বেশি বয়সী নারী, পুরুষেরা।
–তাদের ভিডিও করতে কেন? এইগুলো কেন করেছো?
–সব বয়সের নারীদেহের কাটা ফাঁড়ার ভিডিও করতাম। অবসরে দেখতাম। এই আর কি…
২০১৫ সালে হাইকোর্ট এক আদিবাসী নারীর অপমৃত্যু মামলার রায়ে এক ঐতিহাসিক নির্দেশ দেন। তাতে বলা হয়, কোনও নারীর অপমৃত্যু হলে, তাদের শুক্রাণু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। দেখতে হবে অপমৃত্যুর আগে কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা। তারপর থেকে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব আদালতের নির্দেশ মেনে আসছে। ভাগ্যিস, না হলে কি আর এই রকম একটি কলংকজনক বিষয় মানুষের সামনে আসতো? শুনতে হতো এই কালো অধ্যায়? হা আমার শ্রষ্ঠা! আর পারি না…
তারা পরষ্পর পরষ্পরের দিকে তাকায় সন্দিহান দৃষ্টিতে। মুন্না ধরা পড়ার এক মুহুর্ত আগেও কি সে বুঝতে পেরেছিলো, এই ঘৃণিত কাজের জন্য সে এইভাবে ধরা পড়বে কোনদিন? না, বোঝেনি। অথচ সে ধরা পড়লো খুব অল্প দিন বাদেই। ধরা পড়লো এক সুক্ষ তদন্তে। না, মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। আর ভাবতে পারছি না কিছুই। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে? এটাই বোধ হয় প্রথম। খবরের কাগজটা একপাশে ভাঁজ করে রেখে এককাপ চায়ের তেষ্টায় রান্নাঘরে ছুটে যায় মন। তখনও দূর থেকে ছাতিমের গন্ধ নাকে এসে লাগে। পৃথিবী কি এরকমই…
Add Comment