গল্প

একটা পিতলের ল্যাম্প

প্রচ্ছদ: লেখক

-আইয়ুব আল আমিন

সেদিনও আমার জ্বর ছিল আজকের মতই। গা পুরে যাচ্ছিল তাপে। রাজশাহীতে মেসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আবোল তাবোল বকছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হয়েছি সবে মাত্র। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর বাতাস। জানলার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে শরীরে লাগে আর জ্বরের শরীর ঝাকি দিয়ে ওঠে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হলো বৃষ্টিটা কমলে মোড়ের দোকানে গিয়ে মাকে ফোন করবো। তখন সবার হাতে হাতে এমন মোবাইল ফোন ছিলনা। দোকান থেকে ফোন করতে হতো আমাদের বাড়ীর পাশে বাজারের দোকানে। তখন সে আম্মাকে ডেকে দিতো। তারপর কথা হত। সে এক বিশাল ঝয়ঝক্কির ব্যাপার।
আমাদের মেসে শুধুমাত্র শরীফ ভাই এর একটা মোবাইল ফোন ছিলো। লম্বা বাঁশের সাথে এন্টেনা লাগিয়ে কথা বলতেন উনি। মেসের সবাই তাকে খুব ভয় পেতো। কেউ তার সাথে কথা বলতো না। লম্বা লম্বা চুল। দেখতে উঁচা লম্বা ফর্সা ধবধবে। রাজনীতি করতেন। অসম্ভব তার দাপট। সেই সময় বেনসন সিগারেট প্যাকেট প্যাকেট শেষ করতেন তিনি। কোন ইয়ারে, কোন বিষয়ে পড়তেন, কি সমাচার, এইসব আমি না শুধু, মেসের কেউই জানতো না।
সবাই বলতো নতুন আইছো মেসে। আউ ভাউ বুইজ্যা চলবা। রুমতো নিছো বাঘে খাঁচার সামনে। আর যাই করো শরীফ ভাইয়ের সামনে পইরো না। আর শোনো; ভাই যখন বের হয় শার্টের নিচে কোমড়ে একটা জিনিস ফুইলা থাকে ওটা কি জানো?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম;
না, আমি কিভাবে জানবো!
তখন গলা নামিয়ে বলতো; পাগলাচুদা ওইটা হইলো কাটা রাইফেল! ভাইয়ের সাথে সবসময় থাকে। খুব খেয়াল কইরা থাকবা। দেশ গ্রামের পোলা, আস্ত একটা খ্যত আইছো তুমি।

শুনে আমার বুক ধরফর করা শুরু করলো। সিদ্ধান্ত নিলাম মেস ছেড়ে দিব। আর যাইহোক বন্দুকওয়ালা এক ডাকাতের সাথে থাকা যাবে না কিছুতেই। আম্মাকে ফোন করে একদিন যখন এই বন্দুকওলার কথা বললাম। আম্মা চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো ফোনেই। পড়াশোনার কোনো দরকার নাই। তুই বাবা আইসা পর। এক্ষন রওনা দে। যাইহোক তাকে বুঝালাম এই মেসটা ছেড়ে দিব, ভালো ছাত্রদের সাথে থাকবো এই সেই হেনতেন। এদিকে আমি খুবই ভয় পেতে শুরু করলাম। সক্কালে বের হয়ে সারাদিন থাকতাম চারুকলায়। রাতে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিতাম আর খুলতাম না।
একদিন হলো কি খুব সকালে কেউ একজন আমার রুমের দরজায় নক করছে। ফুটো দিয়ে দেখি আর কেউনা শরীফ ভাই। কাম সারছে!
পুরো শরীর কাঁপা শুরু হলো আমার থর থর করে। আত্তাহিয়াতু পড়ে বুকে ফু দিয়ে দরজা খুললাম।

কি মিয়া, চারুকলায় পড়ো শুনলাম। রুম লাগাইয়া কুইচ্চা মুরগী হইয়া থাকো ক্যান? ফুর্তিফার্তা করবা, গাজামাজা খাইবা! খাও নাকি? আমি কাচুমাচু করে বললাম না ভাই…
ধুর!!!
আসো, আমার রুমে আসো। একটা কাম কইরা দেও। একদৌড়ে স্টেশন বাজার যাও পাঁচটা ব্যানসন নিয়া আসো। এই মোড়ে শালারা ব্যানসন রাখেনা। ফকিন্নির জাত সব। আমি কইলাম ঠিক আছে ভাই এক্ষণি আনতাছি। উনি টাকা বের করছেন আমি এদিক সেদিক দেখছি যে কাটা রাইফেলটা দেখা যায় কিনা। বাস্তবে কোনোদিন দেখিনাই এই জিনিস। নাহ, দেখতে পেলাম না কোথাও। এলোমেলো রুম। সবজিনিস এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো। তার মধ্যে আমি দেখতে পেলাম অদ্ভুত একটা জিনিস। একটা পিতলের ল্যাম্প। এতো সুন্দর দেখতে। আগের দিনে রাজা জমিদারদের প্রাসাদে যেমন থাকতো ঠিক ওই রকম। সারাগায়ে মানুষ হাতিঘোড়া ফুল লতাপাতার নকশা, উপরে একটা লম্বা ফুলতোলা কাঁচের চিমনি। উনি এটা কোথায় পেলেন ভেবে পেলাম না। টাকা নিয়ে উনাকে সিগারেট এনে দিলাম। ওই একদিনই দেখা তার সাথে আমার। উনিও থাকেন না সারাদিন আমিও থাকি না। বেশিরভাগ সময় উনি রাতেও ফিরেন না। দেখা হয়ই না।

এর মধ্য ক্যাম্পাসে রমা নামে এক দিদির সাথে পরিচয় হয়েছে। রোকেয়া হলে আমার একটা বান্ধবীর রুমমেট। বান্ধবীকে ফোন করতাম রমাদির মোবাইলে। তখন দিদির সাথেও একটু আধটু কথা হতো। তারপর দেখা হলো একদিন, ছবি এঁকে নিলো, নানকিং এ নিয়ে খাওয়ালো। উনি গণিতে পড়তেন ফোর্থ ইয়ারে, থিয়েটারও করতেন। আমার বান্ধবীর চেয়ে তার সাথেই সখ্যতা বাড়তে লাগলো দিন দিন। মাঝে মাঝেই দেখা হতে লাগল আমাদের। আমি সন্ধ্যায় রাকসু ভবনের সামনে গিয়ে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। দিদি রিহার্সেল করে বের হলে আমরা কোনো কোনো দিন সাহেব বাজার চলে যাই রিকসায় করে। পদ্মার পাড়ে গিয়ে কালাই রুটি খাই। আমার সামনের দুটো দাঁত বড় বড়। দিদি বলতেন তুই আমার ইন্দুর পাখি। ইন্দুরের মত দাঁত তোর। মেরে ছোটা ডার্লিং। তার আসল ডার্লিং থাকতো ঢাকায়। বুয়েটে পড়তো। ভাইয়া যখন আসতো রাজশাহীতে ওই কয়দিন দেখা হতো না। আমার রাগ লাগতো খুব। মন খারাপ করে একা একা ঘুরতাম। মনে মনে পণ করতাম আর কোনোদিন দেখা করবো না। মরে গেলেও না। কিন্তু ভাইয়া চলে গেলে আবার যা তাই।

সেসময়ই রমাদি জিন্স টপস পরে ঘুরতো ক্যাম্পাসে। দেখতে শ্যামলা, খাঁড়া নাক, টানা টানা চোখ, খয়েরী চোখের মনি। ছোটখাটো ছিপছিপে শরীর। মনেই হতো না অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী।
দিদি গল্প করতো প্রচুর। তার সব গল্পের বিষয় হতো ঘুরে ফিরে ওই গণিত। অথচ গণিতে আমি সারাজীবন ফেল করতে করতে পাশ করছি। দিদি বলতো; গণিত হইলো দুনিয়ার সব চেয়ে সহজ বিষয়। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতাম।
সে গণিত দিয়ে ধর্ম বুঝাতো, প্রেম বুঝাতো, জীবন বুঝাতো। তখন সত্যি সত্যি মনে হত গণিতও কবিতার মতই।
আমাদের এতোটা সখ্যতা দেখে ক্যাম্পাসের অনেকেই আড় চোখে তাকাতো। দিদি বলতো সবাই বুঝে গেছে তোর সাথে আমার মাখামাখি ধরনের প্রেম… হিহি। মজা না বিষয়টা? আমি বলতাম হু।
আহারে এতো মাখামাখি প্রেম তবু কোনোদিন নরম করে প্রেমিকার হাতটাই ধরতে পারলি না, ইন্দুর পাখি আমার! কইলজাটা!!!
বলেই খিল খিল করে হেসে উঠতো।

দুইদিন জ্বরের কারণে দেখা হয়নি। পরেরদিন সকালেই চলে এসেছে আমার মেসে। কপালে হাত দিয়েই চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো;
কুত্তার বাচ্চা, জ্বরে ফিট পরে আছিস একবার জানাসনি। মরলি না কেন্, মরা দেখতে আসতাম তোর।
বলে নিজেই কলতলা থেকে বালতি ভরে পানি এনে মাথায় ঢালতে লাগলো। জ্বরের ঘোরে মনে হলো পৃথিবীতে মানুষ মানুষের কত আপন। এই দূর দেশে কে আমি, কে সে। অথচ কি এক মমতার জাদু। এর নামই কি ভালবাসা!!
ঘোর বেশিক্ষণ থাকলো না মেসের আসেপাশের কিছু বখাটে তরুণ মেসের ভিতর ঢুকে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল; এদের আমি সবসময় দেখি মোড়ের দোকানে আড্ডা দিতে।
মেয়েছেলে নিয়ে আমরা এলাকায় থাকি এটা তো মাগিপাড়া না! রুমে মেয়ে আইন্যা নষ্টামি করবা চোক্ষের সামনে, এটা তো হইতে দেওয়া যায়না। মাগির বেটি কোন রুমে, ওর চুলের মুঠি ধরে বের করে আন….

দিদি রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলছে, এসব কি বলছেন আপনারা! ছেলেটা অসুস্থ, তাছাড়া সে আমার ছোট। ভাইএর মত….
ওই সব ছিনালিপনা শুনেছি মেলা, ধরা পড়লে নাং রে কয় বাপ… আমরা তো ঘাস খাইনা…
ওই ওরে পিছামোড়া করে বান……
এমন হইচই শুনে হঠাৎ বাঘের খাঁচাটা খুলে গেলো, শরীফ ভাই বের হয়ে বললেন কি হইছে সকাল সকাল এইখানে? এতো চিল্লাচিল্লি কিসের? ঘটনা কি?
ভাইকে ঘটনা বোঝাতে সময় লাগলো না দিদির।
এদিকে ভাইকে দেখে ওদের গলার স্বর নিচু হয়ে গেছে কিছুটা। উনি মেসের একজন ছেলেকে বললেন; কেঁচি গেটটা তালা মেরে একটা মোটা বাঁশ নিয়ে আয় তো, দৌড় দে। কথা শুনে ওদের মধ্যে থেকে পাতলা একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো কি করবেন? সাথে সাথে ভাইয়ার এক ঘুসিতে ওই ছেলের উপরের দাঁত পড়ে গেলো তিনটা।

সব কয়টা খানকির ছেলেকে আজকে লাশ বানিয়ে পাঠাবো… বলেই রুম থেকে একটা বড় রড নিয়ে বের হতেই কে কোনদিকে পালালো জানিনা।
জ্বর সারলো কয়েকদিনে। তার কিছুদিন বাদেই শুরু হলো ফাইনাল পরীক্ষা। ওই ঘটনার পর দিদিও আর আগের মত নাই। কেমন যেন হয়ে গেছে। দেখা করতে গেলে নানা কাজের অজুহাত দেখায়। বলে তোর পরীক্ষা চলছে। ঠিকঠাক পড়াশোনা কর। এভাবে এতো ঘোরাঘুরি করা আসলেই ঠিক না। সত্যি খারাপ দেখায় রে…..
পরীক্ষা শেষ করে পরের দিনই বাড়ী রওনা হলাম। যেতে যেতে মনে পড়লো দিদি কিছুদিনই আগে বলেছিল তোর ফাইনাল পরীক্ষার পর তোকে সোনা মসজিদ দেখাতে নিয়ে যাব। সারাদিন আমরা ঘুরবো। হাঁসের মাংস রান্না করে নিয়ে যাব আমি রুম থেকে….
ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ঘোলা হয়ে গেলো।
অনেকদিন ছুটির পর ফিরে এসে শুনলাম শরীফ ভাইকে একটা খুনের মামলায় ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
এটা শুনে তার বাবা হার্ট এটাক করে মারা গেছে। একদিন ভাইয়ার মা এলেন মেসে। তালা ভেঙ্গে তার রুমে ঢুকে বসে বসে কাঁদলেন অনেকক্ষণ।
আমি আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বললাম চাচিমা, চলেন আমরা জেলখানায় গিয়ে ভাইকে দেখে আসি….
শুনে উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।
আমরা দুজন গেলাম। সেদিন দেখা হলো না। আমাদেরকে অন্য একদিনের ডেট দিলো। সেদিন গেলাম আমরা সকাল নয়টার আগেই।
সারাদিন বসে আছি জেলখানার গেটে দেখা আর হয় না। বিকেল চারটায় ডাক পড়লো আমাদের। সময় দশ মিনিট। শরীফ ভাইকে আমরা দেখে চমকে গেলাম। শরীর শুকিয়ে হাড় আর চামড়াটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। মাথা ন্যাড়া করা। ফর্সা শরীর কালো হয়ে গেছে কত।
চাচীমা হাউমাউ করে কাঁদছেন। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। তাঁকে জাপটে ধরে আমিও কাঁদছি।
চাচীমা বলছেন; তোর বাবা মরে বেঁচে গেছে শরীফ । আমি পারিনা থাকতে বাবা… কসম পারিনা সোনা মানিক। তুই বুঝিস না কেনো!!!!!
শরীফ ভাই কিছু্ই বলছেন না।
দেখলাম উনারও চিবুক গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল।
আমাকে বললেন তুই কেনো কাদঁছিস পাগলা?
মাকে নিয়ে বাড়িতে যা……

চাচীমাকে বললেন মা, বাংলা ডিপার্টমেন্টে মনোয়ার নামে একটা ছেলে আছে খুব গরীব, ওর বাপটা মানুষের বাড়ীতে কাজ করে ওকে পড়াশোনা করাচ্ছে। রুমের সব জিনিসগুলো তাকে দিও শুধু আমার পিতলের ল্যাম্পটা বাদ দিয়ে।
ওটা আমার এই পাগলা ভাইটাকে দিও…

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930