সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-নাসরিন সিমি
শ্রীময়ীর সকাল থেকে মন খারাপ। ব্যাথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সংসারের নিত্যকর্ম করতে গিয়ে হাত পা যেন আলগা হয়ে আসছে।
মা কী এখন কাঁদছে? নাকি ধর্মকর্ম করছে মৃতের আত্মার শান্তি কামনা করে। ছেলে মেয়েরা জানে আজ কেন মায়ের এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বারবার চোখ মুছছে।
মেয়ে: এই রোদেল শোন। আজ আম্মুকে কোন যন্ত্রণা করবি না।
ছেলে: আমি জানি অবন্তী। তোকে মনে করিয়ে দিতে হবে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যাম্পু সাবানের ফেনা ছুটিয়ে বেশ আয়েশ করে স্নান সেরে যথারীতি নিত্য দিনের ব্যতিক্রম না করে শ্রীময়ীর সাথে অকারণে চিল্লাচিল্লি করে হাসপাতালে গেলো শ্রীময়ীর স্বামী ডাক্তার আনন্দ।
ডাক্তার আনন্দ সকালে বেরিয়ে রাত এগারোটায় সেদিন বাসায় ফেরে।
শ্রীময়ী সকালে কেঁদে কেটে নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। নিত্য দিনের ঘরকন্নার কাজকর্ম করে।
শ্রীময়ী ফোনটা কাছাকাছি রাখে। আজ ওর কাছের আত্মীয় স্বজনেরা দুই মিনিটের জন্য হলেও ফোন দেয়। দুঃখ প্রকাশ করে। স্বান্তনার কথা শোনায়।
শ্রীময়ী খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে ডাক্তার আনন্দের একটা ফোনের জন্য। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত দশটা বাজে প্রায়। আনন্দ একবারও ফোন করেনি শ্রীময়ীকে।
শ্রীময়ী দুপুরে খেতে পারেনি। খেতে ইচ্ছে করেনি।
শ্রীময়ীর স্বামী ডাক্তার আনন্দ রাতে ফেরে খুব হাসিখুশি মনে। হাতে একটা বেলি ফুলের ম্যাড়ম্যাড়ে মালা। মালটা বুক পকেটে রেখে বাসায় নিয়ে আসে। মালটা দেখে ভীষণ অবাক হয় শ্রী। টেবিলের উপর মালাটা রাখে আনন্দ।
বেডরুমে গিয়ে আনন্দ প্যান্ট শার্ট চেঞ্জ করে। শার্টটা ওয়াশিং বাস্কেটে রাখতে বলে। শ্রীময়ী হাত বাড়িয়ে শার্ট নেয়। সাদা রঙের শার্টের পিঠে ডায়িং করা ব্যারগান্ডি কালারের একটা লম্বা চুল লেগে রয়েছে।
শ্রীময়ীর বুক চিরে কান্না পায়। বাথরুমের বসে ঝরঝর করে কাঁদে। আনন্দ চেঞ্জ করে মোবাইল ফোনে তখন চ্যাটিং শুরু করেছে।
শ্রীময়ী বাথরুম থেকে বের হয়ে ড্রইং রুমে আসে। বাসী বেলি ফুলের মালাটা হাতে নেয়। শ্রীময়ী হঠাৎ খেয়াল করে মালাটার সাথে সেই বারগ্যান্ডি কালারের আরেকটা চুল। তবে চুলটা একটু খাটো। আনন্দ উঠে আসে। শ্রীময়ীকে মালাটা হাতে জড়িয়ে রঙিন নতুন ফ্রিজের ওপর হাত রেখে ছবি তোলে। শ্রীময়ী এই জবরদস্তি মেনে নিতে পারেনা। এক ঝটকায় হাত থেকে মালা খুলে বেডরুমে গিয়ে বালিশ আঁকড়ে কাদতে থাকে লজ্জা ও অপমানে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
আজ শ্রীময়ীর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। আনন্দ সেটা ভুলে গেছে। শ্রীময়ীর বাবার মৃত্যুটা ছিলো অস্বাভাবিক। সে এটা মেনে নিতে পারেনি। একমাত্র সন্তান হিসেবে এক মুহূর্তের জন্য সে কোনদিন বাবাকে ভুলতে পারেনি।
শ্রীময়ীর ছেলে মেয়েরা পাশে চলে আছে। মাকে রাতের খাবার খেতে বলে। ছেলে মেয়ে দুটোতেই রাতে খাওয়া দাওয়া করেনি। তাদের মন খারাপ ছিলো নানাভাইয়ের জন্য।
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। শ্রীময়ী টেবিল রেডি করে সবাইকে খেতে ডাকে। শ্রীময়ী খেতে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। ভাতের পাতে অশ্রু গাল বেয়ে পরছে।
আনন্দ এসব কিছুই দেখছে না। শ্রীময়ীর দিকে তাঁর তাকাবার সময় নেই কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা তো বৃথা।
আনন্দকে খেতে ডাকছে। ডাকাডাকিতে সে প্রচন্ড বিরক্ত। তার এখন সংসার সন্তান ও শ্রীময়ী কে বোঝা বা সংসারের কোন কিছু মনে কলার সময় নেই। ডাক্তার আনন্দ এখন তাঁর ছাত্রী সুমাইয়া শওকত এর সাথে মনযোগ দিয়ে আন্তরিক ও আবেগ নিয়ে চ্যাটিং করছে।
শ্রীময়ী ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে সারাদিন একা একাই কাদঁলো অঝোর ধারায়। চোখের জল মুছে দেয়ার জন্য সেদিন এক বক্স টিস্যু ও ছিলোনা বাসায়।
Add Comment