সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার
-আইয়ুব আল আমিন
বাসা বদল করার কথা আরও দু তিন মাস আগে। আমি থাকি নিচ তলায় বাসার মালিক তিন তলায়। ছিমছাম মধ্যবয়স পেরুনো মানুষ। শুনেছি তিনি দারোগার চাকরি করতেন। এই মানুষটা কিভাবে দারোগাগিরী করতেন আমি ভেবে পাইনা। ঢাকায় বাড়ীওয়ালারা চিরকলিন যে স্বভাবের হয় এই মানুষটা তার ধারে কাছেও নেই। বাসার গেটে কোনোসময় দেখা হলে তিনিই মনে হয় লজ্জায় কাচুমাচু করতেন। যেখানে নানা কারণে এমন অবস্থা হওয়ার কথা আমারই।
তাঁকে শ্রদ্ধাও করি নিজের বাবার মত।
যা বলছিলাম, প্রতিমাসে বাসা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি নতুন বাসা খোঁজার নাম নেই।
পনেরো বিশ তারিখের দিকে গিয়ে বলি চাচা বাসা কি ভাড়া হয়ে গেছে?
উনার হাসিমুখ দেখেই বুঝতে পারি বাসা এখনো ভাড়া হয়নি।
বলি সামনের মাসটাও থাকি চাচা। টু লেটটা নামিয়ে রাখেন।
এই বাসাটা পুরোনো। কোনো দারোয়ান ফারোয়ান নেই।।
নিচে আমি যেখানে থাকি সেখানে দুটো রুম। এতো নোংড়া আর শ্যাতশ্যাতে!!!
দেয়ালের প্লাস্টিক, মেঝের প্লাস্টিক সব উঠে উঠে গেছে। কেউ সহজে যে এ বাসা ভাড়া নিবেনা তা আমিও নিশ্চিত।
কিন্তু বিপত্তি টা বাঁধলো গতমাসে।
আমি বেশকিছুদিন ঢাকায় ছিলাম না। ফিরলাম চব্বিশ তারিখে।
চাচা এসে বললেন বাবা, বাড়ী তো ভাড়া হয়ে গেছে। তোমাকে অনেক খুঁজেছি, ফোন করেছি পাইনি। অগত্যা ভাড়া দিয়ে দিলাম। আমি তবুও রাখতে চেয়েছিলাম। পারলাম না এবার।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার।
রাত পোহালেই পঁচিশ তারিখ। মাসের এমন শেষ সময় বাসা পাই কোথায়!
পরেরদিন হন্যে হয়ে খুঁজলাম। কোথাও বাসা পেলাম না।
তারপরদিনও না।
অন্যসময়গুলোতে গলির পাশে দেয়ালগুলোর দিকে তাকানো যায় না। বাসা ভাড়া, বাসা ভাড়া পোস্টারে সয়লাব। এখন খুঁজতে এসে হাড়ে হাড়ে বুঝলাম এসবের উপযোগিতা আসলে কত পারসেন্ট!
একবার ভাবলাম বাসাতেই আর যাব না। এখান থেকেই চলে যাই ঢাকা ছেড়ে৷ কয় পয়সার জিনিস আর আছে বাসায়।
একটা ভাঙ্গা খাট, দুটো বালিশ, লেপ তোষক আর কিছু জামা কাপড়। শুধু সেল্ফ ভর্তি বইগুলো দামি। ওগুলোতেই মায়া!
ধুর! চুলোয় যাক মায়া!
কিছুক্ষণ বাদেই বুঝলাম ইচ্ছা করলেই সব করা যায় না।
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে শুয়ে পড়েছি।
বাড়িওয়ালা চাচা এসে জিজ্ঞেস করলেন বাসা পেয়েছি কি না?
না পেয়ে থাকলে উনার ছোট বোনের ওখানে একটা বাসা খালি আছে উঠতে পারি।
তবে ভাড়াটা সামান্য বেশি।
-দেখো কি করবা বলে তিনি চলে গেলেন।
আমার আর দেখাদেখি নাই এক তারিখ বিকেলেই বোঁচকা বাচকি নিয়ে নতুন বাসায় উঠে গেলাম।
এ বাসাটা দোতালায়। পুবের দিকে বেলকুনি। ঝকঝকে দেয়াল।
মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে গেলো। আর তখনি মনে পড়লো মিতুর কথা । সে এই বাসাটা দেখলে নিশ্চই অনেক খুশি হত।
একটা সুন্দর বাড়ীর জন্য কি না করেছে মেয়েটা।
কিভাবে সাজানো হবে, কোথায় ফুলদানি, কোথায় বুক সেলফ্, বাড়ীর পর্দাগুলোতে কিরকম নকশা হবে সেটাও এঁকে এঁকে দেখাতো।
আমি তাকে শুধু বলতাম; সব হবে।
পথের পাঁচালির হরিহরের মত তোমার সব কথা, আমি জানি। সব হবে সব হবে…. ছাই হবে, বলে মুখ ভার করে বসে থাকতো।
আমি বলতে পারতাম না কিছুই।
তিনচারদিন চলে গেলো নতুন বাসায় কিছুই গোছানো হয়নি।
অথচ সারাদিন বাসাতেই থাকি।
অফিসের ম্যানেজার বলেছে আপনি কয়েকদিন নাহয় রেস্টেই থাকেন। আর ভালো করে চিকিৎসাটা করান। দরকার পড়লে ইন্ডিয়া যান।
সেখানে এখন কত বড় বড় রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। আপনার টা তো সামান্য।
উনি সামান্য বললেও আমি জানি এই সামান্যের গভীরতা কতটা!
আজকে বইগুলো সব কোনোমতে গোছাতে পারলাম।
পুরনো বইগুলোর মাঝে “প্রজাপতি” বইটা খুঁজে পেলাম। পাতা উল্টাতেই মিতুর হাতের লেখা “শুভ জন্মদিন কবি”
বইটা হাতে নিয়ে বহু কথা মনে পড়ে গেলো তখনকার। আরও কিছু পাতা উল্টে নাকের কাছে গন্ধ নিয়ে দেখলাম। কোথাও মিতুর গন্ধ নেই…
স্নান করতে গিয়ে হটাৎ আয়নার দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক্ করে উঠলো। আয়নার এককোনায় একটা সবুজ টিপ লাগানো। এ কয়দিন চোখে পরেনি। অনেকক্ষণ চোখ সরলো না অকারণেই। মনটাও কেমন খারাপ হয়ে গেলো।
হাত দিয়ে টিপটা স্পর্শ করে দেখতে মন চাইলো।
ছোট্ট একটা জিনিস অথচ একসময় কত ভালবাসায় ছিল জিনিসটা!
কত মমতায় খুলে রেখেছেন যত্ন করে।
হয়তো ভুলে গেছে যাবার সময়। নয়তো পুরনো জিনিস, ইচ্ছে করেই নিয়ে যায়নি।
সরারাত ঘুমাতে পারলাম না।
মাথার মধ্য সবুজ একটা টিপ ভনভন করছে।
কয়েকবার উঠে পানি খেলাম।
বেলকুনিতে গিয়ে বসলাম।
সত্যি কি আমার অসুখটা বাড়ছে।
আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি আসলেই?
নিজেকে বুঝালাম অনেক। এই সামান্য জনিসটা নিয়ে এমন পাগলামি করার কিছু নাই…..
সকালে উঠে রাতে নিজেকে বুঝানো সব কথা বেমালুম ভুলে গেলাম ।
অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে আমি বুঝতে পারলাম মিরপুর থেকে যখন মোহাম্মদপুরের বাসে উঠেছি টিপটা পকেটে করে নিয়ে।
অনেক কষ্টে খুঁজে বের করেছি যারা আগে এখানে থাকতো। তারা এখন মোহাম্মদপুরে উঠেছে।
মাথায় ভন ভন শব্দটা আজ এতো জোরে করছে আমার পাশের লোকটাও সেটা শুনতে পাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি।
আর কতক্ষণ লাগবে যেতে!
আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। প্রচন্ড জ্যাম। ঘেমে নেয়ে সারা শরীর একাকার। শেষে আমি কল্যাণপুরের আগেই নেমে হেঁটেই রওনা হলাম।
দুপুরের অনেক পরে খুঁজে পেলাম বাসাটা। ড্রইং রুমে গিয়ে বসেছি। তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে তবু পানি খাওয়ার কথা না বলে আগে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বললাম।
আমার আসার কারণ শুনে ৩৫/৪০ বছর বয়সী যুবক আমার সাথে কি আচরণ করেছিলেন সেদিন…. সেটা মনে করলে অবশ্য অতটা খারাপ লাগে না।
শুধু দারোয়ানটার জন্য খারাপ লেগেছিল খুব।
আমার মত একজন মানুষ বাসার ভেতর পর্যন্ত ঢুকলাম কি করে সেটার জবাব দারোয়ানটা দিতে পারেনি।
এদিকে আমার বাড়ীর মালিকও পরের মাস থেকেই বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে। আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। আর কত?
বাসাটাসা আর নেবো না। এখানে একটা লাইব্রেরী আছে। বইগুলো ওদের দিয়ে দিলেই শেষ….
কলিংবেল বাজছে, এসময় ময়লা নিতে আসে। কতদিন বলেছি এই বাসায় রান্নাবান্না হয়না। বাসায় ময়লা টয়লা নেই। তবু প্রতিদিন বেলটা বাজাবেই এসে। পরপর তিনবার যখন বাজলো তখন মনে হলো না, অন্য কেউ….
কম বয়সী শাড়ী পড়া একজন মহিলা।
-আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি চিনি আপনাকে। আমার টিপটা নিতে এলাম। আর সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সবুজ রঙের শাড়ী পরা, সাইড ব্যাগে একটা মেরুন ফুলতোলা ছাতা, চুলগুলো সুন্দর করে আচড়ানো কিন্তু কপালটা খালি…
জানেন আসিফ সাহেব, ভালো মানুষগুলোকে আমরা পাগল বলা শুরু করেছি। ওই টিপটার মত কত ছোট ছোট আবেগ, মমতা বুক পকেট, শাড়ীর আচলে করে ঘোরা মানুষ আর এই শহরে নেই। আপনার মত দু একজন যারা আছে তারা পাগল হয়ে যায় একদিন, বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়ে, বড়রা দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়।
বলতে বলতে তার চোখ ছলছল করে উঠলো…
বুঝলাম এইজল বাঁধ মানবে না…
চিবুক বেয়ে এখনি গড়িয়ে পড়বে মাটিতে,
আমি কিছুই করতে পারবো না……
Add Comment