গল্প

ডিভোর্স

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-তাহমিনা তানি

এইমাত্র একটা চিঠি এলো আমার হাতে। টিউশনি করে বাসায় ফিরছিলাম, গেটে ঢুকতেই সিকিউরিটি চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দিলো। হ্যা আমার নামই স্পষ্ট করে লিখা আছে। এর আগে কখনো আমার নামে চিঠি আসেনি, তাই একটা উত্তেজনা কাজ করছিলো। ঘরে ঢুকে তড়িঘড়ি করে রুমে গিয়ে চিঠির খামটা এক টানে ছিঁড়ে ফেললাম।
একটা ডিভোর্স লেটার। প্রথমে ভেবেছি ভুল করে এসেছে, পরে ডিটেইল পড়ে হাত পা অবশ হতে শুরু করলো। সোহেলের কাছ থেকে আসা এটা। এক ছাঁদের নিচে থেকেও কখনো বুঝতে পারিনি এতটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সোহেল মনে মনে!
গতরাতে ঝগড়া হয়েছে সোহেলের সাথে, তাতে তো আজই ডিভোর্স লেটার আসার কথা নয়, মানে আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিলো!
স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টাটা ব্যর্থ করে বারবার আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কোলে বড় বাচ্চাটা, যার বয়স সাড়ে ৩ বছর। অনেকক্ষণ ধরে বাবা, বাবা করছে। ছোটটার বয়স সাড়ে ৭ মাস। কি করবো আমি, কিভাবে এতবড় ঝড় সামাল দিবো! কাকে বলবো, কি বলবো, এর কি কোনো সমাধান আছে?
শাশুড়ীকে ফোন দিতেই ফোনটা কেটে দিলেন। হয়তো শ্বশুর কিছুটা পক্ষে কথা বলবে ভেবে তাঁকেও ফোন দিয়েছিলাম। তিনিও কিছু বলতে পারবেন না বলে রেখে দিলেন। সোহেলের ফোন বন্ধ। দুটো বাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় যাবো, বাবার বাড়ি! কিভাবে যাবো! আমার বাবা মা দু’জনকেই রাখতে ভাই হিমশিম খাচ্ছে, আর্থিক সংকট না হলেও, মানসিক সংকট তো আছেই, তার উপর আমি গেলে কিভাবে নেবে তাঁরা! শ্বশুর শাশুড়ীকে সহনশীল মনে হলো না, তবুও সিদ্ধান্ত ফাইনাল, সেখানেই যাবো।
আজ পনেরদিন হয়ে গেলো, সোহেলের কোনো খবর নাই। শ্বশুর বাড়ি এসেছি, কিন্তু তারাও মুখে তালা দিয়েই চলছেন। মা’কে জানাতে চাইনি কিন্তু মা বারবার ফোন করে, কি হয়েছে জানতে চাইছেন। কেনো শ্বশুরবাড়ি আছি, ঢাকায় কেনো যাচ্ছি না, চাকরি বা টিউশনি ছেড়ে এতদিন কেনো পড়ে আছি – এতসব জানতে চাওয়ায় বলে দিয়েছিলাম। হু হু করে কেঁদে উঠলেন, তাই ফোনটা রেখে দিয়েছি। আশেপাশে কানাঘুষা চলছে, সোহেল নাকি তার কোনো এক ছাত্রীকে বিয়ে করবে বা করেছে।
আমার শরীর জ্বলছে, আলমারি খোলে কাবিননামা বের করে, সোহেলের নামে জিডি করবো, খোরপোশ চাইবো। একথাও বুঝে ফেলেছেন শাশুড়ী, তাই খুব রাগারাগি করে গেলেন, আমি পাত্তা দেইনি।
কাবিননামা খোঁজে পাচ্ছি না, নিশ্চয়ই এটাও পরিকল্পিত। খোঁজাখুজি করছি দেখে শাশুড়ী একটা কাগজ এনে ধরলেন সামনে,
– এটা খুঁজছো তো, তাই না!
– কি এটা?
– যা খুঁজে খুঁজে হয়রান হইতেছো, নাও কাবিননামা।
আমি ঝটপট নিয়ে কাগজটা খোলে অবাক, কাবিননামায় ১২ হাজার টাকা লেখা, যা ঠিক নয়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা!
আমাদের বিয়েটা পালিয়ে বিয়ে করা। বাসা থেকে বেকার ছেলে দেখে রাজি হয়নি বাবা। আমরা ঢাকায় চলে আসি বিয়ে করে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওর বন্ধুকে দিয়ে কাজী আনা হয়, এবং ৫০ হাজার টাকা কাবিননামায় লেখা হয়। কিন্তু এখানে মাত্র ১২ হাজার টাকা লেখা। এটা কি করে সম্ভব!
শাশুড়ী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তাঁর বাড়ী থেকে চলে যেতে আর ভরনপোষণের আশা যেনো না করি । আমি মুখে কিছু বললাম না, তবে একাই ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলাম। বাচ্চা দুটো কাঁদছে, বড় বাচ্চাটা দৌড়ে কাছে আসতেই আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
বুকে পাথরচাপা দিয়ে মা’য়ের বাড়ি এলাম, কাছাকাছি বাড়ি। মা খুব কাঁদছে। সকাল হতেই বের হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। বিয়ের পর আমিই আমার এক ছাত্রীর বাবাকে বলে একটা প্রাইভেট কলেজে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম সোহেলকে। সেখানে গিয়ে বিস্তারিত জানালাম। সোহেলের চাকরিটা আগে খেতে হবে, ওকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে সাজা দিবো, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। তিনি আশ্বাস দিলেন, আমি সেই আশ্বাসের উপর বিশ্বাস রেখে গেলাম “ভিকটিম সাপোর্ট কেন্দ্রে।” তাঁরা যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়ে আমাকে একটি মামলা করতে বললেন।
আমি আমার বাসার সব দামি জিনিসপত্র সরিয়ে ফেললাম, কারণ ওর কাছেও ডুপ্লিকেট চাবি আছে ঘরের। সিকিউরিটিসহ, বাড়িওয়ালাকে জানালাম তার কৃতকর্মের কথা। তারাও আমাকে আশ্বাস দিলেন, কোনোভাবেই এখানে ঢুকতে দেবেনা তাকে। একটা ফোন এলো…
– আপনার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ।
বিশ্বস্ত একজনকে দিয়ে ওর ছাত্রীর ফোন নম্বর কালেক্ট করেছি, একটা মেসেজ দেয়া উচিত। লিখলাম-
“আমি জানি খুব শীঘ্রই তোমাদের আলাদা হতে হবে, কারণ তোমাকে ভরনপোষণ করার মতো ওর কোনো সাধ্য নাই, ওর চাকরি চলে গেছে, আর মনে রেখো, ও আমাকেও এভাবে পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলো। ওর সন্তানদের অভিশাপ নিয়ে তুমি কখনো সুখী হবেনা ইনশাআল্লাহ। ”
রিপ্লাই আসলো, “সন্তান! কে আপনি?”
আমি আমাদের একটা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাঠিয়ে দিলাম, সাথে আমাদের বাচ্চা দু’টোর ছবিও।
কিছুক্ষণ পর একটা ফোন এলো ভিকটিম সাপোর্ট কেন্দ্র থেকে।
– আপনার কাজ হয়ে গেছে আগামীকাল থেকে আমাদের কাজ শুরু, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা সাথে আছি।
– আলহামদুলিল্লাহ।
শ্বশুরবাড়ী থেকে ফোন আসলো,
– তুমি ফিরে আসো, তোমাকে আমরা মেনে নিবো, বাচ্চাগুলাকে নিয়া যাও, আর পারছি না।
– না মা, আপনাদের নাতী, নাতনী, আর আমার তো ওদেরকে ভরনপোষণের সামর্থ্য নাই, কিভাবে আনবো বলেন! তাছাড়া আমি তো এখানে ওদের বাসায় একা রেখে কিছু করতেও পারবো না, তাই না! ওরা আপনার কাছেই থাকুক, আপনার ছেলেকে বলেন ওদের নিয়ে যেতে!
আমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদলাম। আমার বুক ভারী হয়ে আছে, অথচ আমার দুধের সন্তান না খেয়ে আছে। তবুও আমাকে ওদের জন্য, ওদের ছেড়ে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। ওদের অধিকার আদায় করে তারপর আমি ওদের নিয়ে আসবো। আমার বুকের ভেতরে গুঁজে রাখবো….

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031