ইতিহাস-ঐতিহ্য

দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ি’র ইতিহাস

হ্যালোডেস্ক

‘চা’ অত্যন্ত সংবেদনশীল অর্থকরী ফসল। পৃথিবীজুড়েই এর কদর। চা শিল্পের ইতিহাসও প্রাচীন। বলা হয় এই শিল্পের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। তখন থেকেই মানুষ চা পান করতো। প্রথমে মানুষ এটি ঔষধ হিসেবে পান করতো। পরে তা পানীয় হিসেবে, আবার ইতিহাস থেকে জানা যায় মদের বিকল্প হিসেবেও চান পান করা হয়েছে। চা শিল্পের ইতিহাস নিয়ে এই উপমহাদেশে বেশ বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলছেন এর আবিষ্কারক চীন। আবার কেউ বলছেন ভারতীয় উপমহাদেশে। আবুল কাশেম তার চা শিল্পের ইতিহাস বইটিতে লিখেছেন, ‘বিজ্ঞানীরা মনে করেন আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে ক্যামেলিয়া আসামিকা প্রজাতির চা হতো। ১৮২৪ সালে মেজর স্কট এবং ১৮২৩ সালে ক্যাপ্টেন সিএ ব্রুস বা লে. চার্লটন চা গাছ আবিষ্কার করেন। চীনা গাছের চেয়ে এই গাছ বিরাটাকার ছিল। আবার কেউ কেউ চীনা ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস ও ক্যামেলিয়া আসামিকাকে একটি প্রজাতি ও এক উত্পত্তিস্থলের উদ্ভিদ মনে করেন। তাদের মতে, তিব্বতের মালভূমি থেকে এই প্রজাতির উত্পত্তি হয়ে চীন ও ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বিশ্বে ৩৮,০০,০০০ টন চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। ১৭৭৪ সালে চীন থেকে প্রথম ভারতে বীজ আনা হয় এবং ১৭৭৮ সালে জোসেফ ব্যাংক হিমালয়ের পাদদেশে চা আবাদের সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন। এদিকে চায়ের আবিষ্কার নিয়ে বেশ মজাদার পৌরাণিক কাহিনিও রয়েছে।

চাষ পদ্ধতি
চা প্রধান কান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের ফসল হলেও উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলেও এটি কিছু কিছু চাষ করা যায়। প্রথম অবস্থায় পাহাড়ের ঢালু জমি পরিষ্কার করা হয়। এর চারা পৃথক বীজতলায় তৈরী করা হয়।

চারাগুলো যখন ২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হয়, তখন সেগুলোকে চা-বাগানে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হয়। সাধারণতঃ দেড় মিটার পরপর চারাগুলোকে রোপণ করা হয়ে থাকে। এরপর গাছগুলোকে বৃদ্ধির জন্য যথামাত্রায় সার প্রয়োগ ও পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এভাবে দুই থেকে তিন বছর পরিচর্যার পর পাতা সংগ্রহের উপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু গাছগুলো পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত যথাযথভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। একটি চা গাছ গড়পড়তা ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত উৎপাদনের উপযোগী থাকে। তারপর পুনরায় নতুন গাছ রোপণ করতে হয়।

প্রাকৃতিক উপাদান
প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়িয়া বা উচ্চ ঢালু জমি চা চাষের জন্য সবিশেষ উপযোগী। পানি নিষ্কাশনের বন্দোবস্ত থাকলে উচ্চ সমতল ভূমিতেও চা চাষ করা সম্ভবপর। হিউমাস সারযুক্ত এবং লৌহমিশ্রিত দো-আঁশ মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। চা চাষের জন্য ১৭৫-২৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত আবশ্যক। এজন্য মৌসুমী ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চা চাষের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।

প্রকারভেদ
পৃথিবীতে আসাম এবং চীনজাতীয় – এ দুই প্রকারের চা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আসামজাতীয় চা গাছ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অধিক চাষ করা হয়। এ ধরণের গাছ বেশ বড় এবং বহু পাতাযুক্ত হয়। বিধায়, এটি বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করার জন্যে বিশেষ উপযোগী। এ গাছ প্রায় ৬ মিটার বা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতার নাগাল পাওয়া এবং পাতা সংগ্রহের জন্য গাছগুলোকে ১.২ মিটার বা ৪ ফুটের অধিক বড় হতে দেয়া হয় না। ছেঁটে দেয়ার ফলে চা গাছগুলো ঘণঝোঁপে পরিণত হয়।

অন্যদিকে চীনজাতীয় গাছ আকারে বেশ ছোট হয়। এতে পাতার সংখ্যাও অনেক কম থাকে। এ গাছ না ছাঁটলেও পাতা তোলার মতো উচ্চতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।

চা গাছ হতে পাতা সংগ্রহ করতে ব্যক্তিকে যথেষ্ট নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কারণ দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসঙ্গে তুলতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষ ও আমেজ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। চীন ও জাপানে বছরে গড়পড়তা তিনবার চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় খুব ঘন ঘন পাতা সংগ্রহ করা যায়। এদেশগুলোতে বছরে গড়ে ষোল থেকে বিশ বার পর্যন্ত চা পাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

গুণাগুন
চীনজাতীয় গাছের পাতা স্বাদ ও গন্ধের জন্য সুখ্যাত। কিন্তু আসামজাতীয় গাছের পাতা রঙের জন্য বিখ্যাত। এই দুই ধরণের চা-পাতার উন্নত সংমিশ্রণের উপরই এর গুণাগুন নির্ভর করে। স্বভাবতঃই চা মিশ্রণ একটি নিপুণতা ও অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই এটি অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদনা করতে হয়। এরূপভাবে চা মিশ্রণে নৈপুণ্যের লাভের প্রেক্ষাপটে লিপটন, ব্রুকবণ্ড প্রভৃতি চা প্রস্তুতকারক কোম্পানী বিশ্ববাজার দখল ও খ্যাতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশে চা চাষ
২০০৩ সালে বিশ্বে চা উৎপাদিত হয়েছিল ৩.২১ মিলিয়ন টন। ২০০৮ সালে বিশ্বের চা উৎপাদন ৪.৭৩ মিলিয়ন টনেরও বেশি হয়েছিল। সর্ববৃহৎ চা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে – গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং তুরস্ক অন্যতম।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
চা গাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়িয়া অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চায়ের চাষ করা হয়। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি এবং এখান থেকে চা রফতানি করা হয় ২৫টি দেশে। চা উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টমে। বাংলাদেশে চা পানকারীর সংখ্যা প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম৷ সে তুলনায় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে রপ্তানীর পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

বর্তমানে ৪৭,৭৮১ হেক্টর জমিতে ১৬৪টি। চা বাগানের মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৪৮টি চা বাগান। তন্মধ্যে ৯০% চা সিলেট বিভাগে এবং অবশিষ্ট ১০% চট্টগ্রাম বিভাগে উৎপন্ন হয়। প্রায় সকল চা বাগান ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত। তবে সাম্প্রতিককালে পঞ্চগড় জেলায় কিছু নতুন চা বাগান স্থাপিত হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশ চা রপ্তানি করে অনেক আয় করত। কিন্তু বর্তমানে চা আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ড এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৮ কোটি ৮৯ লাখ কেজি চা ভোগ করা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ছিল এর থেকেও কম।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, চেক ও স্লোভাক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, জাপান, মিশর, সুদান, জর্ডান, গ্রীস, সাইপ্রাস, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে চা রপ্তানী করা হয়। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী সিলেট টি নামে খ্যাত।

আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন।

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031