কবিতা

ধূলিরাষ্ট্র

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-তৃষ্ণা বসাক

কোন কাজে হাত দেবার আগে, আমাকে বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখে নিতে হয়
বাবার মৃত্যু দৃশ্য,
হ্যাঁ মৃত্যুও কখনো কখনো দৃশ্য আর তার নিয়তিতে অনিবার্য ধূলো,
যেমন ধূলো ১৮ টি শিশুর অবয়বের ওপর, এক সপ্তার মধ্যেই
সমস্তই স্বাভাবিক, এই মৃত্যু, এইসব ধূলোর জটলা,
ধূলো তো শেষ পর্যন্ত ধূলোতেই ফিরে যাবে
এরকম তো কতই হয়, বানতলা থেকে গুজরাট পর্যন্ত,
‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ শুনতে শুনতে আত্মা ঢুকে যায় নতুন খোলসে,
শুধু রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা কাটামুণ্ডু
কয়েক ইঞ্চি দূরের ধড়ের সঙ্গে কিছুতে মিলতে পারে না,
পারে না অনেক রাতে বাড়ি ফিরে মাকে বলতে
‘ভাত খাব, বড্ড খিদে পেয়েছে’

এ সমস্তই স্বাভাবিক, এই ভাতের থালা থেকে ক্রম-বিচ্ছিন্নতা,
এই কোমল ভাতের শরীরে অন্তর্গত তিল,
এগুলো দেখার আগে
আমাকে বারবার মিলিয়ে নিতে হয় বাবার মুখ,
নিরন্তর ভাঙ্গাচোরার মধ্যেও তদ্গত সেই অপেক্ষা
জলে ক্রমে ক্রমে ডুবে যাওয়া হাতের আর্তি-
এসবই দেখে নিতে হয় রিওয়াইন্ড করে….

দিন যায়, মৃত্যুসালটি প্রায় মাধ্যমিকের মানে বইয়ের মতো অপরিহার্য,
আর তার সংক্রমণ অন্যান্য বছরগুলোতে
যেসব সংখ্যাগুলো তার পরেও পৃথিবীতে এসেছে,
কাঁধে কয়েক রিম আকাটা কাগজ,
কাটিং মেশিনের দিকে ধেয়ে যেতে যেতে
আমি চুপিচুপি দেখে নিচ্ছি কলেজ স্ট্রিটের সূর্যাস্ত,
এর কয়েকবছর পর এখানেই ট্রাম এসে চুম্বন করবে আমাকে
আর পাণ্ডুলিপির বর্মে ধাক্কা খেয়ে
মৃত্যু মাথা নিচু করে ফিরে যাবে বাটার মোড় থেকে…..

এমন দৃশ্যে কার্যতই হতভম্ব দুপুরের রেতঃপাত হয়ে যায়।
বৃষ্টির জলের মতো সেই তরল হয়তো বা ধরে রাখে মাটি,
বহু বহু প্রসবের পরেও যার ক্লান্তি নেই,
বরং এখনও সে বিপুল উদ্যমে
ঝুঁকে পড়ে তুলট কাগজের জন্মপত্রের ওপর।

কিন্তু আমি এত পারি না, পারি না যে তা তো স্পষ্ট,
দেখতে পাই শিমূলের উচু ডালে
কে বা কারা লাল ডাকবাক্স বেঁধে দিয়ে যায়,
ঠিক যেমন অর্জুন অস্ত্র বেঁধে এসেছিল শমিবৃক্ষে,
আর অত উঁচুতেও চিঠি আসে, বিলি হয়ে যায় দ্রুত,
দেখতে পাই পঞ্চাশ হাজার বছর পরের মানুষের জন্যেও
ঝোলায় চিঠি ভর্তি করে ছুটে চলেছে কে ও,
এই তো এক্ষুনি হাঁফাতে হাফাতে চিঠি ফেলে গেল এক বালক,
এক তরুণী, দুজন বৃদ্ধ ভিখারি….

দেখতে পাই, আর এত বমি পায় আমার!
এই নিরন্তর লেখালেখি, ডাকাডাকি, ছুঁয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা-
আমি যখন ছুঁতে চেয়েছিলাম, তখন তো পৃথিবী একটা ফুটন্ত তরল,
তখনো ভেড়ি বুজিয়ে উপনিবেশ গড়ে ওঠেনি,
আর বরফের চূড়ো থেকে ঈশ্বর মাঝে মাঝে সমতলে নেমে আসতেন
অম্ল ও লবণের সন্ধানে।

সেই সময়টা মহাশূন্যে একটা নশ্বর খাঁজ,
আমি কাউকে বলিনা সেই খাঁজটার কথা
কিংবা সেই অসামান্য প্রাজ্ঞ রথ-
যে জেনেছিল প্রোথিত হওয়া ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই,
‘প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস
প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস’
সাধ মিটিয়ে রক্ত খেতে খেতে বিড়বিড় করেছিল ভুশুণ্ডি কাক…..

সেই কাকটা প্রায়ই এসে বসে আমার পাঁচিলে,
হ্যাঁ আমার চারপাশে এখন পাঁচিল,
মানুষসমান বলতাম,
কিন্তু আজকাল মানুষ পাঁচিলের চেয়ে লম্বা হতে পারে না,
চারপাশে পাঁচিল নিয়ে আমি নিজেই একটা রাষ্ট্র
এ ওয়ান, এ টু, এ থ্রি, সব, সব বাড়িগুলোই এখন রাষ্ট্র হয়ে গেছে,
এতগুলো রাষ্ট্র যখন স্বাধীনতার কুচকাওয়াজ করে
তখন কাকচিলও বসতে পারে না কাছাকাছি,
শুধু সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কাক
চুপচাপ বসে থাকে আমার পাঁচিলে
কখন আমার রথের চাকা বসবে সেই আশায়,
‘প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস
প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস’
আমিও কাকটার মতো জপতে জপতে
রথের চাকা মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করি!

কিন্তু যেকোনো কাজ শুরু করার আগে
আমাকে বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখে নিতে হয় বাবার মৃত্যু,
টেবিল থেকে টেবিলে ফাইলের কফিনে চড়ে
চালান হয়ে যায় ১৮টি শিশুর মৃতদেহ,
ধূলো, পুরু ধুলোয় দুচোখ আবৃত করে আমি বসে পড়ি,
মহার্ঘ বসনের মায়া না করে আমি বসে পড়ি রক্তকীর্ণ প্রান্তরে,
সৌরবলয়ের মধ্যে আমি এক দগ্ধডানা মানুষ-
হে মৃত্যু, আমাকে ভুল করেও প্রণত ভেব না!

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930