হ্যালোডেস্ক
মধ্য বয়সের সাধারণ একজন নারী পারেনা সংসার ভেঙে দিতে কিংবা স্বামীকে আইনীভাবে সাজা দিতে।
৫০ এর কাছাকাছি বয়সের তাহমিনার( ছদ্মনাম) এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেক ছেলে ও মেয়ে কলেজ পড়ুয়া। শহরের এক থানায় তাহমিনা পরিচিত মুখ। তার কারণ প্রায় ২ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে সে স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে অভিযোগ নিয়ে আসে। স্বামী কখনো মেরে রক্তাক্ত করে দেয় , কখনো হাত পা ভাংগে। থানায় এসে কান্নাকাটি অভিযোগ করে । পুলিশ সব শুনে প্রতিবারই মামলা করতে বলে। কিন্তু তাহমিনা নির্যাতনের মামলা করে না। স্বামীকে অভিযোগের কারণে পুলিশ ধরে আনলে ছেলে মেয়ে, আত্নীয় স্বজনের চাপে ছাড়িয়ে নিতে হয় তাকে। প্রায় ২৫ /২৬ বছরের সংসার জীবনে তাহমিনার এমন নির্যাতন শুনে অবাক হতে হয়।
এবার তাহমিনার হাত দুটো আঘাতে বিৎভস অবস্থা। ভারী শরীর আর মারাত্মক ব্যাথার কারনে হাঁটতে পারছে না। এত কিছুর পরেও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না তাহমিনা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যতই আইনের কথা বলুক, সে মামলা করতে নারাজ। দুদিন হাজতে রেখে সাজা দিতে চায়। কিন্তু মামলা করে শাস্তি দিতে সাহস পায় না। মুখে বলে দরকার হলে ডির্ভোস দিবে। তাও আসলে হবে না। থানায় মেয়েরা আর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার পক্ষে বয়ান দেয়। কিন্তু অন্যভাবে এ ঘটনা চাপা দিতে দ্বিগুন তৎপর তারা। থানার অফিসারের অবস্থা বেগতিক। ভিকটিম না চাইলে মামলা করা অসম্ভব।
মধ্যবয়সী তাহমিনার দীর্ঘদিনের সংসারে এ অবস্থা কেন – এমন কৌতুহলী প্রশ্ন সবার মনে। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সামান্য সম্পত্তি তাহমিনার জীবনকে করেছে অনিশ্চিত। স্বামী চায় তাহমিনা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা তাকে দিয়ে দিক। অনেকটা উচ্ছেন্ন যাওয়া স্বামীর সব যন্ত্রণা সয়ে যে মা সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়েছে ; সে সন্তানরাও বাবার বিরুদ্ধে মায়ের থানাতে আসাকে পছন্দ করে না।
বলা হয়ে থাকে বর্তমানে নির্যাতনের কারণে দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ বাড়ছে দিন দিন। তবে এ ক্ষেত্রে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মধ্য বয়সের নারীরা সংসারের নির্যাতন নিয়ে সহজে মুখ খুলে না। সে হোক কর্মজীবী কিংবা গৃহিনী।
তার কারণ হলো নিজের বয়সের সাথে সাথে সংসার জীবনের ২০ /২৫ বছর পরের হিসেবটা বড় জটিল। তখন স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের পরিসর বৃদ্ধি পায় সন্তানদের ঘিরে৷ সমাজে নিজেদের একটা অবস্থান থাকে। সে হোক মধ্যবিত্ত, উচ্চ বিত্ত বা নিম্নবিত্ত৷ সেখানে ব্যক্তি সম্মানের পাশাপাশি পারিবারিক মান সম্মান বিশেষ ভুমিকা পালন করে। পরিবারের সদস্যেদের চাওয়া পাওয়াকে অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়।
আরেক ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের পৌরুষত্ব জাহির করার সর্বপ্রথম মানুষটি হলো সেই নারী, যিনি তার ঘরের স্ত্রী। এর জন্য কোন সময় কাল, স্থান, পাত্রের প্রয়োজন হয় না। স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলার পথে অনেক কাঁটা। সে পথে চলতে গেলে মনের আবেগ আর বাস্তবতার লড়াইটা মধ্য বয়সের বেশির ভাগ নারীর জন্য অবাস্তব চিন্তা। স্বামী সন্তান যে তখন তার একমাত্র জগত।
অন্যদিকে বাংগালীদের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ‘সেক্রিফাইস’ শব্দটি যেন মায়ের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ। বাবার অন্যায়কে প্রতিবাদ করার সাহস আধুনিক কালেও তেমনভাবে দেখা যায় না। বরং মায়ের প্রতি আবদার, আকুতি থাকে বাবার চাওয়াকে মেনে নেয়ার৷ তথাপি একজন ৫০ বছরের নারী যদি ২৫/ ৩০ বছরের সংসার করার পর যে কোন ধরনের নির্যাতনের কারনে স্বামীকে ডির্ভোস দেয় ; তাহলে সেটা হয় ব্যতিক্রমী ঘটনা। তবে একই ঘটনা স্বামীর বেলাতে ‘ হতেই পারে’ বলে মেনে নেয়।
নারীর প্রতি নির্যাতনের জন্য আইন রয়েছে। সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও হয়। কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয় বিবাহিত নারীরা৷ শারিরীক নির্যাতন দেখা গেলেও মানসিক নির্যাতন ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় নারীদের।
আর এ ক্ষেত্রে মধ্য বয়সের সাধারণ একজন নারী পারে না সংসার ভেংগে দিতে কিংবা স্বামীকে আইনীভাবে সাজা দিতে। সে ভাবে এমন প্রতিবাদে ছেলে মেয়ে সমাজের কাছে হেয় হবে। আর যদি ছেলে মেয়ের সংসার থাকে তাহলে নির্যাতনের নীলকন্ঠ অবগাহন ছাড়া গত্যন্তর হয় না।
এ কারণে বর্তমান সময়েও এগিয়ে যাওয়া সমাজে মধ্য বয়সের এ নারীরা পরিবার, সন্তান স্বামীর মান সম্মানের নামে পরাধীনতার শিকল পরে আছে । ফলশ্রুতিতে তারা আবেগে ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে; কেবল নিজেকে বলিদান করে পরিবারের সম্মান বাঁচাতে। আর আইন নির্বাক হয়ে যায় মার খাওয়া তাহমিনার শরীরের কালশিটে দাগগুলো দেখেও৷ কারণ নির্যাতিত তাহমিনা নিজেই বিচারের পথকে রুদ্ধ করে দেয়, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় লোক দেখানো মান সম্মানের ভয়ে।
Add Comment