বিশ্ব বাবা দিবস
-রাখী নাথ কর্মকার, কলকাতা
‘ফাদার’স ডে’ এমন একটি দিন, যেদিনটি আমাদের জীবনে এই বিশেষ ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের আন্তরিক ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। অবশ্য শুধুমাত্র বাবা নয়, দাদা, কাকা বা যে কোন ‘ফাদার ফিগার’ বা পিতৃসুলভ ব্যক্তির সন্তানের জীবনে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। পিতৃত্ব, পিতৃত্বের বন্ধন ও সমাজে ‘ফাদার ফিগারে’র সম্মান জানানোর এই দিনটি আমাদের এটুকুই মনে করিয়ে দেয়, যে, মায়েদের সঙ্গে আমাদের দৃঢ় বন্ধনের মতোই এটিও এমনই একটি বন্ধনের অভিজ্ঞতা যা আমরা প্রায়শই ভুলে থাকি।
ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলিতে, মধ্যযুগ থেকেই ১৯শে মার্চ ‘সেন্ট জোসেফ দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়। আশীর্বাদধন্যা ভার্জিন মেরির স্বামী এবং যিশুখ্রিষ্টের আইনী পিতা সেন্ট জোসেফের ‘ফীস্ট ডে’ উদযাপনের এই ঐতিহ্য স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ ঔপনিবেশিকরা আমেরিকায় বয়ে নিয়ে এসেছিল। আমেরিকাতে ফাদারস’ ডে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সোনোরা স্মার্ট ডড, ১৯১০ সালে প্রথমবারের মতো জুনের তৃতীয় রবিবারে পালিত হয়েছিল ফাদারস’ ডে। তাঁর বাবা ছিলেন গৃহযুদ্ধের সিভিল ওয়্যার ভেটেরান উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট, যিনি ‘সিঙ্গল ফাদার’ হিসেবে তাঁর ছয়টি সন্তানকে বড় করে তুলেছিলেন। ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে পিতৃ দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। প্রাথমিকভাবে পিতৃদিবস পালনের ধারণাটা কিন্তু বেশ হালকাভাবেই নেওয়া হত, ‘মাদার’স ডে’র মতো উন্মাদনা বা ভাবাবেগ এই দিনটিতে অনেক সঞ্চারিত হতে বেশ সময় লেগেছে। বাবারাও যে সন্তানের প্রতি সমান দায়িত্বশীল তা অনেকসময়েই রূঢ় বাস্তবতার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন ফাদার’স ডেকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও বিভিন্ন দিনে এটি পালিত হয়ে থাকে, বেশিরভাগই অবশ্য মার্চ, মে এবং জুন মাসে।
বর্তমানে আমেরিকাতে শিশুজন্মের আগে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের পিতাকেও সন্তানের লালন-পালনের জন্যে কিছু নির্দিষ্ট ট্রেনিং দেওয়া হয়। ডেলিভারি রুমে পিতার উপস্থিতি এখন সেখানে অত্যন্ত নিয়মিত হলেও অবশ্য ১৯৭০এর দশক অবধি, বেশিরভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে শিশুর জন্মের সময় পিতাকে ডেলিভারি রুমে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জুডি লিভিট তাঁর “মেক রুম ফর ড্যাডি: দ্য জার্নি ফ্রম ওয়েটিং রুম টু বার্থিং রুম” বইয়ে সন্তানের জন্মের সময়ে পিতার উপস্থিতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন – কীভাবে বিভিন্ন উইমেন’স মুভমেন্ট ও ন্যাচারাল চাইল্ডবার্থ মুভমেন্টের মধ্যে দিয়ে পিতারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থেকে সন্তান জন্মের মুহূর্তে এক দৃঢ় বন্ধনের অংশীদার হয়ে ওঠেন, তা তিনি জানাতে ভোলেন নি। একটি শিশুর জন্মের সময় থেকেই তাই বাবা ও মা দুজনের বন্ধনই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়।
‘ফাদার’স ডে’তে আমরা একজন পিতার অবদান, সন্তানের প্রতি তাঁর ত্যাগকে স্মরণ করে তাঁকে সম্মান জানাই। ফুল, কার্ড বা ডিনার…হয়ত সামান্য উপহার, কিন্তু শ্রদ্ধাটুকুর ব্যাপ্তি অসামান্য! হলেনই বা তিনি এক নরম মনের মানুষ; হলেনই বা তিনি মজাদার, বন্ধুবৎসল; কিংবা হলেনই বা তিনি পাথরের মতো শক্ত এক কঠোর প্রাণ যিনি কখনও অশ্রু বর্ষণ করেন নি… তাঁরা সর্বদাই আমাদের জীবনে এক নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তি হিসেবে উজ্জ্বল থেকে যাবেন। আমরা সর্বদাই তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছি, ঠিকভুলের আপেক্ষিক হিসেব শিখে এসেছি, তাঁদের কাছ থেকেই সর্বদা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জেনেছি। বিশ্বসংসারে মাথা তুলে দাঁড়াবার শিক্ষাও তাঁদের কাছ থেকেই পেয়েছি। ক্লান্ত দিনের শেষে বাবার পরিচয়ই আগলে রাখে আমাদের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সারাটি বছরে কেবল একটিমাত্র বিশেষ দিনই কি বরাদ্দ করা হবে বাবা বা মাকে সম্মান জানানোর জন্যে? না, অবশ্যই তা নয়। যাঁরা আমাদের পৃথিবীর আলোয় নিয়ে এসেছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যাঁরা আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার, লড়াই করার মন্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের জন্যে একটি দিন মোটেই যথেষ্ট নয়। এই দিনগুলি আসলে প্রতীকী দিবস। যে দিনের মধ্যে দিয়ে আমরা যে শুধু আমাদের জীবনে মাতা, পিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানকে স্বীকার করে সারা বছর ধরে জমিয়ে রাখা আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি তাই নয়, নিজেরাও ঋদ্ধ হই। “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ, পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।”…অর্থাৎ পিতা স্বর্গ, ধর্ম এবং পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্টিতেই সর্ব দেবতার সন্তুষ্টি!
Add Comment