আন্তর্জাতিক
―বেনিন স্নিগ্ধা
আমরা সবাই জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সারা বিশ্বের জন্যাই অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার দরূন সমগ্র বিশ্বই আসন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে উন্মুখ হয়ে আছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। তবে, নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান, যে দলের প্রার্থীই নির্বাচিত হোন না কেন, বাংলাদেশের জন্য এ নির্বাচন খুব একটা গুরুত্ব বহন করেনা। কারণ, একটি কথা প্রচলিত আছে – প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সচরাচর পরিবর্তনশীল নয়। তবে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তার হারানো সুযোগ সুবিধা ফেরত পাওয়ার দাবি করতেই পারে। তার আগে একটু পেছন ফিরে যাওয়া যাক।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র : সম্পর্কের গতি প্রকৃতি
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকলেও সেখানকার সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের ব্যাপক সমর্থন ছিলো বাংলাদেশের প্রতি, যার জের ধরে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৪ মাস পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এরপর থেকে গত ৪৮ বছরে দু’দেশের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে বিশেষ করে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই এখন এককভাবে বড় দেশ। আবার এ মূহুর্তে বাংলাদেশে আসা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের পরেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। ১৯৭২ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল যার অধীনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য বিভিন্ন পর্যায়ে পেতে শুরু করেছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদারই হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০০০ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিল ক্লিনটন। পরে ২০১২ সালে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। বাংলাদেশে তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত দু’দেশের সম্পর্ককে ‘স্পন্দনশীল, বহুমুখী, এবং অপরিহার্য’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।। আবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অনুরোধে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে কসভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতন্ত্রহীনতা কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলে কিছু উষ্মা দেখা যায় মাঝে মধ্যেই। আবার শেভরন, কনকো ফিলিপের মতো মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগ নিয়েও তীব্র সমালোচনা আছে বাংলাদেশে। তবে এর মধ্যেও একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেই। বাংলাদেশ বিদেশে যা রপ্তানি করে তার এক পঞ্চমাংশই যুক্তরাষ্ট্রে। আবার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী এবং কৌশলগত সামরিক মিত্র হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব কারণে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ
▪বাণিজ্যি ক ক্ষেত্রে জিএসপি (GSP) সুবিধা : রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় ১৪টি শর্ত দিয়ে জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে এসব শর্ত পূরন করলেও তারা আর এ সুবিধা ফেরত দেয়নি। তবে এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট যে-ই হোন না কেন, নির্বাচন পরবর্তীকালে জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা এ বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাও জড়িত।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ৮.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে অনেক আগেই এবং দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য আছে Trade & Investment Co-operation Framework Agreement (টিকফা)। পাশাপাশি Blue Economyর বিস্তৃত দিগন্ত সামনে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সেখানে বড় বিনিয়োগ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের আগ্রহ ও সক্ষমতা আছে। তবে তাদের প্রশাসন আরও কার্যকর ভাবে এগিয়ে আসলে এ জায়গাটি আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা যায়।
শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য : যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ৩য় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এবং এ রপ্তানি আরও বাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে সরকার ও রপ্তানিকারকরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পোশাকে শুল্ক আরোপ করে অথচ পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের জন্য শুল্ক নেই। কারখানার মান, পণ্য মান, কাজের পরিবেশ, শ্রম উন্নয়নসহ সবকিছুতেই বাংলাদেশের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ নি:সন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাওয়াগুলোর একটি।
রোহিঙ্গা ইস্যু : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ইস্যুষতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের আরও শক্ত অবস্থান নেয়ার সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই মিয়ানমারকে চীনা বলয় থেকে বের করতে পারবেনা। তবে তারা জাপানকে ব্যবহার করেও মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অভিবাসন ও রেমিটেন্স : যুক্তরাষ্ট্র হলো ‘Country of Immigrants’, অর্থাৎ অভিবাসীদের দেশ। ঐ দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ। যদিও অনেকে এ সংখ্যা ১০ লক্ষেরও বেশি বলে মনে করেন। বৈধ অভিবাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশীদের জন্য এ সুবিধা অব্যা হত থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলে ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সহজ। সে কারণেই বহু শিক্ষার্থী এখনো যেতে পারছে। বাংলাদেশ চাইবে এটি যেন অব্যাহত থাকে। বৈধ অভিবাসনের জন্যও বাংলাদেশীদের জন্য ভালো জায়গা যুক্তরাষ্ট্র।
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব / ইন্দো-প্যা সিফিক স্ট্র্যাহটেজি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে। গত মাসে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগানের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। সফরে বিগান বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকতে চাই।
আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তন হলেও দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে সাধারণত তেমন পরিবর্তন আসে না। যদিও এবারের নির্বাচনের পর দেশটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যদি নির্বাচিত হন, দেশটির চীন-ভারত বিষয়ক সমীকরণে পরিবর্তন আসতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এলে মুসলিম বিশ্ব নিয়ে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে পারে। সেটিও বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগ হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে এ খাতে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া করোনা ভাইরাসের ভ্যা কসিন সংক্রান্ত বিষয়টি এবং বঙ্গপোসাগরে তেল, গ্যা স অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়টিও বাংলাদেশের জন্যএ ব্যাভপক গুরুত্ব বহন করে।
Add Comment