হ্যালোডেস্ক
শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ (এটি কিছু ক্ষেত্রে “শিরোমণি সম্মুখ সমর” নামেও পরিচিত) খুলনার শিরোমণিতে হওয়া একটি যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) জেনারেল নিয়াজী তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে জনসম্মুখে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেন এবং ঠিক ওই সময় ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বে ৪ সহস্রাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা “শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ” নামের বৃহৎ প্রতিরোধের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়। এখনও এ যুদ্ধের কৌশল ভারত, পোল্যান্ডসহ ৩৫টি দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা কলেজে পড়ানো হয়। বিশ্বের সেরা কিছু ট্যাংক যুদ্ধের মধ্যে শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ একটি এবং একই সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র এই শিরোমণি।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খানের এমন সিদ্ধান্ত যথেষ্ট সন্দেহজনক ছিল। কেননা যশোরে পাকবাহিনীর সেনানিবাস ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত। এর পক্ষের যুক্তি হিসাবে পাওয়া যায়ঃ
মার্কিন সপ্তম নৌবহর আগমনের খবরে তাদের সাথে যুক্ত হতেই হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত নেন। যশোর সেনানিবাসকে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে পারছিলেন না।
তাদের বিশাল ট্যাংক রেজিমেন্ট, পদাতিক সেনা, রাজাকার বাহিনীর বিশাল শক্তি নিয়ে খুলনার শিরোমণি এলাকায় জড়ো হয়। পরবর্তীতে খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। তার মধ্যে জনশূন্য শিরোমণি এলাকায় কমান্ডার হায়াত খান সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গড়েন এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকেন।
যুদ্ধের বিবরণ
হায়াত খান তার সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ব্রিগেড নিয়ে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাছাড়া আটরা থেকে শিরোমণি এলাকার যশোর রোডে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেয়। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করেও কোনো সাড়া না পেয়ে এবং তাদের নীরবতা দেখে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ফুলতলার চৌদ্দ মাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির নেতৃত্বে একটি বড় কনভয়ে করী ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা হয়। মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমণি এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রের নিশানার মধ্যে পৌঁছালে পাকবাহিনীর বিভিন্ন দিক থেকে অতর্কিত হামলার স্বীকার হয়। ওই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সামনে থাকা বিপুল সংখ্যক সেনা হতাহত হয়, তবে প্রচণ্ড ক্ষতির পরও কিছু সংখ্যক সেনা ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্পে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।
কথিত আছে, এদিন মিত্রবাহিনীর বিমান ভুল করে ফুলতলা থেকে অগ্রসরমান মিত্র সেনাদের পাকিস্তানি সৈন্য মনে করে তাদের ওপর বোমা বর্ষণ করে। ফলে মিত্র বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ট্রাক ভরে ভারতীয় সেনাদের মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখে স্থানীয় লোকজন। পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনী তাদের পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন ভাবে ঢেলে সাজায়।
ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্প থেকে মিত্রবাহিনী মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর এবং ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল যৌথভাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। কথিত রয়েছে, ভারতীয় মিত্রবাহিনির প্রধান মেজর জেনারেল দলবির সিং নিজ সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার জন্যে মেজর মঞ্জুরের হাতে পুরা যুদ্ধের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নেন। মেজর মঞ্জুর উপ-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ-কৌশল তৈরি করেন। চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুল থেকে মেজর জয়নাল আবেদিনের (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) নেতৃত্বে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়। রেডিও সেন্টারে নিরাপত্তার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকেই পাঞ্জাবী সেনারা মোতায়েন ছিল। পাকিস্তানী বাহিনী ১৭ ডিসেম্বর সকালে রেডিও সেন্টার ক্যাম্পে অস্ত্র সমর্পণ করে এবং মেজর জয়নাল আবেদীন ও লেঃ গাজী রহমতউল্লাহ দাদু (বীর প্রতীক) সকাল ৯টায় যৌথভাবে সার্কিট হাউজে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
মিত্র বাহিনীর অপর একটি ইউনিট ইস্টার্ন জুট মিল গেট এলাকা দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমণির ঠিক পূর্বপাশে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে গোলা ছুড়তে থাকেন। ওই সময় মেজর মঞ্জুর তাঁর বাহিনীকে নিয়ে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে শিরোমণির সীমিত অবস্থানে ঘিরে ফেলেন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা না মেনে তাঁর বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রাধিক সেনা। ওই রাত থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ সমর। মেজর মঞ্জুর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গী পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে খালি পায়ে মাথায় গামছা বেঁধে শ্রমিকের বেশে দুই হাতে দুইটা স্টেনগান নিয়ে অসীম সাহসের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি ট্যাংক বহরের ভেতরে, প্রতিটা ট্যাংকের ভেতরে খুঁজে খুঁজে একজন একজন করে গানম্যানকে হত্যা করে স্তব্ধ করে দেয় পাকিস্তানি ট্যাঙ্কবহরকে। সারারাত ধরে চলা যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পর্যুদস্ত পাকবাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে মিত্রবাহিনী-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
ফলাফল
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বেলা দেড়টায় সার্কিট হাউস মাঠে লিখিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের বেল্ট ও ব্যাজ খুলে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রমাণাদিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। বর্তমানে এ যুদ্ধের কাহিনী সিলেবাস আকারে আন্তর্জাতিক মিলিটারী একাডেমীতে পড়ানো হয়।
পাদটিকা
স্থানীয় ভাষ্য মতে, “শিরোমণি বাজার ও এর উল্টো দিকে বিসিক শিল্প নগরী ঘিরে কমবেশি চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন কোন গাছ বা ভবন ছিল না যেটি অক্ষত ছিল। প্রতিটি গাছ ও ভবনে শত শত গুলি ও শেলের আঘাতের চিহ্ন ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। আজও কিছু তাল গাছ এবং পুরাতন বড় গাছে সে আঘাতের সাক্ষ্য খুজেঁ পাওয়া যাবে।” স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ওইসব গাছ-পালা ও ঘরবাড়ি দেখে শিরোমণি যুদ্ধের ভয়াবহতা আন্দাজ করা সম্ভব হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভ
এই যুদ্ধের স্মরণে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গিলাতলা সেনানিবাসের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির উদ্যোগ নেয়, ২০১০ সালের ৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম খুলনা-যশোর রোডের গা ঘেঁষে গিলাতলায় স্মৃতিস্তম্ভের (তৎকালীন ৫৩ লাখ টাকা বাজেটে) ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
আমাদের সাথে সংযুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন
Add Comment