সাময়িকী : শুক্র ও শনিবার
১৮ নভেম্বর ২০২২
―মিলা মাহফুজা
রাহাত আরার ছেলের বিয়ের কথা পাকা হলো টেলিফোনে টেলিফোনে। একথা রাহাত আরা নিজেও বিশ্বাস করছেন না। আত্মীয়-স্বজনের কথা তো বাদই রইল। বিয়ের কথা যা বলার তা বলেছে ছেলে সাব্বির আর তার হবু বউ সাবেরা। নিজেরা নিজেরা। একদম ফাইনাল করে সাব্বির তার আব্বা-মাকে সামনে বসিয়ে বলল, ‘আগামী সোমবার সাবেরাকে বিয়ে করতে যাব।’ বলেই উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। সাব্বির যে সাবেরা নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করবে। জানতেন রাহাত আরা ও শওকত আলী। যেটুকু খোঁজ খবর পেয়েছেন তাতে আপত্তি করার কিছু পাননি। সবই ঠিক ছিল। সাব্বিরের চাকরি হয়েছে। মাস ছয়েক পরে সাবেরার ফাইনাল পরীক্ষার শেষ হলে বিয়ের কথাবার্তা বলবেন এমনই সাজানো ছিল। মাঝখানে করোনা এসে জাঁকিয়ে বসায়, অপেক্ষা করার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। ও পক্ষের কোনো তাড়া ছিল না, আর রাহাত আরা তো ঢাকঢোল না পিটিয়ে ছেলের বিয়ে কথা ভাবতেই পারেন না। তাই তিনিও করোনার বিদায় নেয়ার জন্যে অপেক্ষা করবেনই, যদি তা আরও অনেকদিন হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। মানে তার মাথায় ছেলের বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তাই ছিল না। তাই ক’দিন ধরে সাব্বিরের খুব বেশি চুপচাপ হয়ে আছে দেখেও পাত্তা দেননি। ঘরবন্দি জীবন কোনো তরুণের কত দিনই বা ভাল লাগে। নিজেদেরই তো ডিপ্রেশন ডিপ্রেশন লাগছে। কিন্তু এ হলো নিয়তির খেলা। না মেনে উপায় নেই। আর তারা একা তো নন, সারা পৃথিবী জুড়েই তো মহাতা-ব চালিয়ে সব মানুষের জীবন যেন বেড়াছেড়া করে তুলেছে আজীব অসুখ করোনা। অন্তত নিজের খুব কাছের কেউ করোনায় এখন পর্যন্ত মারা যায়নি, তাতেই যেন স্বস্তি। সেই স্বস্তিতে সাব্বিরের মতো সুবোধ শান্ত, বাবা-মাকে মান্য করা ছেলে, এমন একটা ধাক্কা দেবে কল্পনাতেও ভাবেননি।
ছেলে উঠে যাওয়ার পর সাব্বিরের মা রাহাত আরা নাকের পোটা আর চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন, ‘একমাত্র ছেলের বউ হবে, আর মেয়েটাকে একবার দেখাও হলো না।’
সাব্বিরের আব্বা শওকত আলী বিমর্ষ গলায় বললেন, ‘আহ্ কাঁদছো কেন? কেঁদো না। ওর সাথে কথা বলো, এমন হুট করে বিয়ে করতে চাচ্ছে কেন?’
রাহাত আরা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করবো কেন? তুমি জিজ্ঞেস করলে না কেন?’
শওকত আলী বললেন, ‘না মানে আমার মনে হলো ছেলেটা খুব কষ্টে আছে? আর ও তো আমার সাথে তেমন খোলাখুলি কথা বলে না, তাই জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হলো।’
‘বলার হলে নিজেই বলত।’ বলে রাহাত আরা ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, ‘প্রথম সন্তানের বিয়ে, কত ধুমধাম করব ভেবেছিলাম!’
-বাদ দাও ওসব। সোমবার মানে হাতে মাত্র একদিন, দেখ কতটুকু কী করা যায়।’
শুনে রাহাত আরার ফোঁপানি বাড়তে থাকলে শওকত আলী উঠে গেলেন।
শেষপর্যন্ত ঠিক হয়েছে বরযাত্রায় যাবে বাপ-মা, এক মামা, এক ফুপু আর বরকে ধরে মোট আট জন। নতুন গয়না কেনার অনুমতি দেয়নি সাব্বির। গয়নাগাটি লাগবে না বলেছে। তবু রাহাত আরা নিজের গয়না থেকে একটা সেট গোপনে ননদের কাছে দিলেন। নতুন বউ খালি হাত-কান-গলায় আসবে শ্বশুরবাড়ি! এতটা বয়সে কোনদিন এরকম দেখেননি রাহাত আরা। বিয়ের শাড়িও কিনতে বারণ করেছিল সাব্বির। রাহাত আরা লুকিয়ে কিনলেন তবু।
সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন- কনে পক্ষ থেকে সাব্বিরের জন্য পোশাক-আশাক কিছুই আসেনি। সাব্বির নাকি বারণ করেছে দিতে। ঘরে নতুন কেনা নীল একটা পাঞ্জাবি ছিল সাব্বির সেটাই পরলো। রাহাত আরা বুক ভাঙা কান্না চেপে চেয়ে চেয়ে দেখলেন। এভাবে বিয়ে করার কী দরকার পড়ল সাব্বির কারুর কাছে মুখ খোলেনি। বিয়ে নিয়ে সে কোনো কথাই বলছে না, শুনছেও না। তার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কারও কথা বলারও সাহস হচ্ছে না। ক্ষোভ আর অস্বস্তি নিয়ে সবাই একদিনে যতটুকু আয়োজন করা সম্ভব করল।
বরযাত্রার মাইক্রোবাসটা জেলা শহরের রাস্তায় ওঠার পর দেখা গেল চারদিক যেন খাঁ খা করছে। ফসলের মাঠে দু’একজন ছাড়া মানুষের দেখা নেই। রাস্তার ধারের দোকানগুলো ঝাপ ফেলা। রাহাত আরার মন আরও খারাপ হলো চারদিক দেখতে দেখতে। সাব্বিরের মামা চাপা বলায় বলল, ‘করোনায় বেশ ক’জন মারা গেছে গত কয়দিনে।’
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার বলল, ‘রোগী হাসপাতালে নিতে ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালেও নাকি সিট নেই।’
শওকত আলী নিজের নার্ভাসনেস কাটানোর জন্যে একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘এসব বাজে কথা বাদ দাও। শুভ কাজে যাত্রা করেছি। সকলে আল্লা আল্লা করো যেন সহি সালামতে সব কাজ হয়।’
কনে বাড়ি পৌঁছে রাহাত আরা আরও ভেঙে পড়লেন। বাড়িটা বেশ বড়সড় হলেও সেটা দেখে কেউ বুঝতেও পারবে না, এখানে একটু পরে কোনো বিয়ে হবে। বাড়িতে মানুষজন আছে বলেও মনে হচ্ছে না। একতলা বাড়ি, সামনে বাগান। আগাছাঢাকা বাগানেই কয়েক ধরনের ফুল গাছে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। তারই মৃদু সুগন্ধ সবাইকে অভ্যর্থনা জানাল যেন। মামা অসন্তুষ্ট মুখে সাব্বিরের দিকে তাকালেন। ফোন করে আসছে তারা, অথচ বাড়ির দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ! সহ্যের একটা সীমা আছে। রাগে লাল চোখে ভাগ্নের দিকে তাকালে দেখেন সাব্বির ফোন করছে কাউকে। কান খাঁড়া করে মামা শুনতে পেলেন, সাব্বির নিচু গলায় বলছে, ‘আমরা বাড়ির সামনে।’
সাব্বির ফোনটা পাঞ্জাবীর পকেটে রাখতে না রাখতে বারান্দার দরজা খুলে দুই যুবক বেরিয়ে এসে, হাত তুলে সকলকে একসঙ্গে সালাম জানিয়ে ভেতরে যেতে অনুরোধ করল। রাহাত আরা তার ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাই তাকে ইশারায় বারণ করল কোনো রিএ্যাকশন দিতে। রাহাত আরার চোখে পানি ভরে উঠল কিন্তু ততক্ষণে সাব্বির নিজে ভেতর দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। বাধ্য হয়ে তাকে অনুসরণ করল অন্যরা।
দুই ধাপ সিঁড়ি আর হাত তিনেক চওড়া একটা বারান্দা পার করে তারা পৌঁছলেন একটা ড্রইং রুমে। সাধারণভাবে ড্রইংরুমে যেমন যেমন আসবাব থাকার কথা তাই রয়েছে। বাড়তি কোনো সাজসজ্জা করা হয়নি। ছেলে দুটি বিনয়ের সাথে সবাইকে বসার অনুরোধ করল। সকলে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন মৌলভি এসে ঢুকলেন ঘরটায়। হাতে রেজিস্ট্রার খাতা। সাথে যিনি এলেন, নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন, আমি মাশকুর রহমান, মেয়ের মামা। মামা সবাইকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের অনুমতি পেলে বিবাহকার্য শুরু করতে পারি।’
কী আশ্চর্য! বরযাত্রীদের এক গ্লাস শরবত দিয়েও অভ্যর্থনা করবে না! আর মেয়ের বাবা-মা-ভাই-ই বা কোথায়? আদতে তারা আছেন তো নাকি?
প্রচ- সন্দেহ নিয়ে মামা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সাব্বির তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘জ্বী, শুরু করুন।’
ফুফু তাড়াতাড়ি গয়নাগাটি আর বিয়ের শাড়িটা যুবক দুজনের একজনকে ডেকে বুঝিয়ে দিল।
রেজিস্ট্রার খাতায় পাত্র-পাত্রীর নাম ঠিকানা দ্রুত লেখা হলো। মৌলভি সাহেব যা লেখা হলো তা গড়গড়িয়ে পড়ে শোনালেন সকলকে। বরের মামা নিজেকে এতক্ষণ বরকর্তা ভূমিকায় ভাবছিলেন। কিন্তু তার কাছে কোনো কিছু জানতে না চাওয়ায় রাগে অপমানে নিজের ঠোঁটে জোর কামড় বসিয়ে ফেললেন। পরে নিজেই পকেট থেকে রুমাল বের করে ঠোঁটে চেপে ধরলেন রক্ত বন্ধ করতে। ঠিক তখনই মৌলভী সাহেব বিবাহে মেয়ের সম্মতি আনতে ভেতরে যাওয়ার সময় তাকেই ডাকতে তিনি অবশ্য সতর্ক পায়ে এগোলেন ভেতর দিকে। অসন্তুষ্ট ননদকে রাহাত আরা একটু খোঁচা দিয়ে ইশারা করলেন ভেতরে যেতে। কিন্তু ফুফু নিজের জায়গা ছেড়ে এক চুলও নড়লেন না।
খুব তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে ফিরে এলেন মৌলভি সাহেব ও মামা। বিয়ে পড়ানো শেষ হলো যেন আটকে রাখা দম ফেলতে বাধ্য হওয়ার আগেই। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নতুন বউ সাবেরাকে দেখা গেল। ভেতরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে সবাইকে হাত তুলে সালাম দিল। বিয়ের গয়নাগাটি পরেনি, এমনকি শাড়িটাও পরেনি, ভাঁজ করা শাড়ির আঁচলটা শুধু মাথার উপর দেয়া, পেছনে একজন ধরে আছে। রাহাত আরা এবার হাসবেন না কাঁদবেন তাই বুঝে ওঠার আগেই সাব্বির উঠে সাবেরার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সবার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে, সাবেরার হাতটা নিজের হাতে ধরে ধীরে বলল, আব্বা, মা, মামা, ফুফু- আমি অত্যন্ত দুঃখিত, তোমাদেরকে কিছু না জানানোর জন্যে।’ একটু দম নিয়ে সে আবার বলল, ‘সাবেরার বাবা-মা-ভাই তিনজনেই করোনা রোগী, হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তাদের জীবন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সাবেরার আব্বার। তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর আগে সাবেরা আর আমার বিয়েটা যেন হয়।’ একটু থেমে সামনের স্তব্ধ মুখগুলো আর একবার দেখে নিয়ে সাব্বির বলে, ‘এখন তোমরা যদি অনুমতি দাও তবে সাবেরা আর আমি একবার তাঁর সামনে একসাথে দাঁড়াতে চাই। জানি না সে সময়টুকু আমাদের আছে কি না।’
রাহাত আরা ফুঁপিয়ে উঠতেই শওকত সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাকি কথা পরে হবে। যাও, দৌড় দাও তোমরা।’
সাবেরা বিহ্বল চোখে শ্বশুরের দিকে তাকাল। তার গাল বেয়ে কান্না ধীর গতিতে নেমে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে রাহাত আরার চোখে অশ্রুধারা নামল হুড়মুড়িয়ে।
বিবাহ আসরটি এসময় সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
Add Comment