গল্প

মধ্যবিত্তের আহাজারি

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-শাহনাজ পারভীন সানি

রান্নাঘরে সায়মা ও হাড়ি-পাতিলের একযোগে চিৎকার চেঁচামেচি চলছে,
—কি যে বাজার করেছে কে জানে, পনেরো দিনও গেলোনা অথচ সব শেষ! কি রান্না করবো,কি খেতে দিবো, কোত্থেকে সদাই আনবো আমি? এই জীবন আর ভালো লাগে না।

সায়মার স্বামী আফসার সাহেবের প্যাকেজিং কারখানায় ছোটখাটো চাকরি থেকে যা পায় তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া,বাচ্ছাদের লেখাপড়া, অন্যান্য খরচ চালিয়ে মাস শেষে একদম সমান সমান হয়। জমা পুজি বলে তাদের তেমন কিছু নেই, এবার তো বেতন পাওয়ার আগেই লকডাউন শুরু। কারখানার মালিক বেতন দিতেও গরিমসি করছে ।
আফসার সাহেব উদাস হয়ে চুপ করে বসে থাকে।
এতক্ষণে সায়মা রান্নাঘর থেকে স্বামীর সামনে এসে এমন উদাস চেহারা দেখে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

—এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কি পেট ভরবে? নাকি কোন একটা ব্যবস্থা করবা? ওই সময় বড় মেয়েটা একটা মাটির ব্যাংক হাতে এগিয়ে এসে বলে,
—আম্মু এটা ভেঙে যা হয় নিয়ে নাও।
সায়মার ও একটা মাটির ব্যাংক আছে, অবশেষে তার ও মেয়েদের মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে যা পায় তা দিয়ে প্রায় দশ-বার দিনের বাজার করে নিয়ে আসে আফসার সাহেব।

বেশকিছু দিন মাটির ব্যংকে জমানো টাকা দিয়ে সংসারের খাওয়াদাওয়ার খরচ চলে যায়। কিন্তু গতকাল দুপুরের পর থেকে সায়মার পরিবারে খাবারের কোন ব্যবস্থা নাই। ছোট মেয়েটা টিভি দেখছিলো,সে হঠাৎ তার বাবাকে ডেকে বললো,
—-বাবা…বাবা দেখো, বস্তিতে খাবার দিচ্ছে চল আমরা বস্তিতে গিয়ে থাকি।
বড় মেয়েটা বলে,
—-ওখানে তো অনেক ভীড়! ওখানে গেলে তো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তুমি মরে যাবে।
মেজো মেয়েটাও বলে ওঠে,
—-এখানে থাকলেও তো আমরা না খেয়ে মরে যাবো।

আফসার সাহেব চুপ করে থেকে তার মেয়েদের কথোপকথন শুনছিলো। হঠাৎ তিনি সায়মা কে বললো,
—কই গো শুনছো, আমি একটু বের হচ্ছি।
—-সায়মা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
কোথায় যাচ্ছো?
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেই আফসার সাহেব স্ত্রীর কথার উত্তর দেয়…
—-যাই….দেখি… দোকান থেকে বাকিতে কিছু আনতে পারি কি না!
কিন্তু দোকানে বাকিতে কিছুই না পেয়ে আফসার সাহেব রাস্তায় কিছুক্ষণ অহেতুকই ঘুরাঘুরি করে, আর লুকিয়ে চোখ মুছে। মেয়েদের কথাগুলো তার মাথার ভিতর কেবলই ঘূরপাক খায়।
অবশেষে আফসার সাহেব বস্তির পথে হাঁটতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর যখন আফসার সাহেব বস্তি থেকে বেরুতে যাচ্ছে ঠিক তখন হঠাৎ করে ওখানে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে যায়। বোরখা পরা এক মহিলার সাথে আফসার সাহেবের জোরে ধাক্কা লেগে দু’জনার হাত থেকে ত্রানের ব্যাগ মাটিতে পরে যায়। ব্যাগ তুলতে গিয়ে দু’জনার চোখাচোখিতে দুজনেই তখন যারপরনাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে!
অতঃপর আফসার ও সায়মা একই রিকশায় বাসায় ফিরে। কিন্তু, একে অপরের সাথে একটি কথাও বলে না। ফেরার পথটুকু শুধু দু’জনার চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে তারা নিঃশব্দে বাসায় ফিরে আসে।

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930